সরস্বতী পুজো মানেই একদিকে বাঙালির অলিখিত প্রেম দিবস, আরেক দিকে বিদ্যার দেবীকে তুষ্ট রাখার প্রয়াস। সব মিলিয়ে স্কুল কলেজের পড়ুয়াদের কাছে সরস্বতী পুজো প্রায় বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই দাবির জেরেই একবার বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছিলেন বাংলার দুই মনীষী। একদিকে খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অন্যদিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস। কী হয়েছিল ঠিক? আসুন, শুনে নেওয়া যাক সে কথা।
ছেলেরা কলেজে পুজো করতে চায়। সরস্বতী পুজো। যারা যারা হোস্টেলে থাকে, পুজো উপলক্ষ্যে বাড়ি যাওয়ার বিশেষ সুযোগও নেই, উৎসাহটা তাদেরই বেশি। অন্যান্য হোস্টেলের ছাত্ররা সরস্বতী পুজোর আয়োজন করে প্রতি বছরই। সেখানে নিমন্ত্রণ খেতে বা জলসা দেখতে গেলেও, নিজেদের পুজোর আনন্দ আলাদা। সেইজন্যই এবার কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে ছেলেরা। অনুমতি চাইতে যাওয়া হল কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে। আর এইখানেই বাধল গোল। এক কথায় তাদের বায়না নাকচ করে দিলেন রাশভারী অধ্যাপক।
আরও শুনুন: SPECIAL PODCAST: উড়ো চিঠির হাতছানি আর স্মৃতির কোলাজে ডুব, বাঙালির বাণীবন্দনা
এত উৎসাহে এভাবে জল ঢেলে দেওয়া! প্রচণ্ড চটে গেল ছাত্ররা। শুরু হয়ে গেল জোর আন্দোলন। পুজো করতে দিতেই হবে। আর এই আন্দোলনেই ছাত্ররা পাশে পেয়ে গেল সুভাষচন্দ্র বসুকে। এদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষের মতে সায় দিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কবে হয়েছিল এমন কাণ্ড? কোথায়ই বা ঘটেছিল এমনতর ঘটনা? তাহলে খুলেই বলা যাক।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণত কোনও ধর্মীয় উৎসবের ছোঁয়া না লাগলেও, সরস্বতী পুজোর কথা আলাদা। হিন্দু ধর্মে তিনি বিদ্যার দেবী বলেই স্বীকৃত, তাঁর পূজার মন্ত্রেও বিদ্যালাভের প্রার্থনাই জানানো হয়, সুতরাং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁর প্রবেশ অবাধ। কিন্তু কোনও ধর্মীয় আচার শিক্ষালয়ে পালন করা আদৌ উচিত কি না, এই নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েই গিয়েছে। ১৯২৮ সালের ওই ঘটনাটিও আসলে তারই নিদর্শন।
আরও শুনুন:
সিটি কলেজে ঘটেছিল এই বিতর্কিত ঘটনা। এই কলেজের রামমোহন হোস্টেলের হিন্দু ছাত্ররা উদ্যোগ নিয়েছিলেন সরস্বতী পুজো করার। এদিকে সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আনন্দমোহন বসু, যিনি ধর্মপরিচয়ে ব্রাহ্ম। অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রও ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য। কলেজে ভরতির ক্ষেত্রে কোনও ধর্মীয় বিধিনিষেধ ছিল না বটে, কিন্তু ব্রাহ্ম মতাদর্শের প্রভাব ছিলই। আর সেই কারণেই মূর্তিপূজায় আপত্তি জানিয়েছিলেন অধ্যক্ষ। কিন্তু সেই সময় বাংলার স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গেও জুড়ে যাচ্ছিল বাঙালি সংস্কৃতির এই আচারগুলি। সেই সূত্র ধরেই পুজো করার দাবিতে ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ালেন কংগ্রেসের তরুণ নেতা সুভাষ। তিনি অভিযোগ তুললেন, পড়ুয়াদের উপর নিজেদের ধর্মবিশ্বাস চাপিয়ে দিচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। এদিকে ‘দ্য সরস্বতী পূজা ইন দ্য সিটি কলেজ হোস্টেল’ নামে এক নিবন্ধ লিখলেন রবীন্দ্রনাথ, যেখানে স্পষ্ট বললেন, “সিটি কলেজ ব্রাহ্মদের, এবং ব্রাহ্মরা প্রতিমাপূজক নহেন, এ-কথা প্রত্যেক ছাত্রই জানেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার ৫০ বৎসর পরে হঠাৎ সেখানে প্রতিমা পূজা করার জন্য জিদ অশোভন।”
হাজার বিতর্ক সত্ত্বেও পুজো হয়নি শেষমেশ। কিন্তু সেই না-হওয়া পুজোর সঙ্গে জুড়েই স্থায়ী হয়ে গিয়েছে বাংলার দুই প্রখ্যাত মনীষার সেদিনের মতান্তরের কাহিনি।