বাগবাজার সার্বজনীনের প্রতিমায় আজও দেখা যায় মার্কিনি চাল। কৃষ্ণনগরের রাজরাজেশ্বরী দুর্গাপ্রতিমায় চালচিত্রে অধিষ্ঠান করেন শিব, পার্বতী, দশমহাবিদ্যা ও দশাবতার। তবে থিমের দৌড়ে হেরে ভূত হচ্ছে সাবেকিয়ানা। সাবেকি পুজোর মতোই অবক্ষয়ের অন্ধকারে নিমজ্জিত বাংলার সেই চালচিত্রও। চালচিত্র কি হারিয়ে যাবে অবলুপ্তির আঁধারে?
পুরনো খবরের কাগজ। তাই জুড়ে জুড়ে তৈরি করা হয় অর্ধগোলাকার ক্যানভাস। তার উপরেই তুলির টানে, নানা রঙের ব্যবহারে ফুটে ওঠে দেবদেবীর অবয়ব। যেমন, শিব, পার্বতী, কালী, চণ্ডী… আরও কত কী! ক্রমেই তা রূপ নেয় রক্তবীজের সঙ্গে সিংহবাহিনীর যুদ্ধের, শিব-পার্বতীর সংসারের, রামাভিষেকের দৃশ্যের কিংবা কৃষ্ণলীলার।
দেবী দুর্গার চালচিত্র নির্মাণের কথাই হচ্ছে। তবে কিনা থিম পুজোর ঠেলায় ফিকে হয়ে গিয়েছে সাবেকি পুজো। সে একচালায় পটচিত্রের চালচিত্রই হোক বা ডাকের সাজ, আজ দেখা মেলা দুষ্কর। চালচিত্রের কাজ হল প্রতিমার নেপথ্যে থেকে মা দুর্গার পূর্ণ রূপ দেওয়া। সে আর কোথায় হয় এখন! হাতে গোনা সাবেকি পুজোর ওপরে নির্ভর করেই বেঁচেবর্তে থাকা শিল্পীদের উপার্জন! এ তো আজকের অবস্থা। তাই বলে চিরটাকাল তো এমন ছিল না। আজকের বাঙালি হয়তো ভাবতেও পারবে না, এককালে চালচিত্র ছাড়া দেবী দুর্গার পুজোই হত না।
চালচিত্র মূলত চার রকমের হয়। যেমন, বাংলা চাল, টানাচৌড়ি চাল, মঠচৌড়ি চাল ও মার্কিনি চাল। মার্কিনি চাল সবচাইতে জনপ্রিয়। ধরুন, প্রতিমার দুইপাশে দুটো থাম। দুই দিক থেকে অর্ধচন্দ্রাকার যে চাল প্রতিমাকে শোভিত করে থাকে, তাকেই বলে মার্কিনি চাল। এই চালের নমুনা হল বাগবাজার সার্বজনীনের প্রতিমা। বাংলা চালে প্রতিমার দুইপাশে মার্কিনি চালের মতো থাম থাকে না। গোল চাল কাঠামোর নিচ পর্যন্ত নেমে আসে। কোনও ক্ষেত্রে কাঠামো ছাড়িয়ে মেঝে পর্যন্তও থাকে। এই চালের উদাহরণ- শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিমা। তবে টানাচৌড়ি, মঠচৌড়ি চালের চলন বরাবরই কম। মঠচৌড়ি চালে প্রতিমার মাথায় প্রায় অর্ধচন্দ্রাকৃতি তিনটি খোপ থাকে। দেখতে অনেকটা জলের ঢেউয়ের মতো হয়। আবার টানাচৌড়ি চালে ওই খোপ তিনটে থাকে না। থাকে একটা কার্নিশের মতো আকার। আর মাথায় থাকে গির্জার চূড়ার মতো তিনটে চূড়া। এছাড়াও আরও তিনটি চালের প্রচলন ছিল প্রাচীনকালে। সেগুলি হল, গির্জা চাল, সর্বসুন্দরী চাল ও দোথাকি চাল। যা বহুদিন আগেই বিলুপ্ত হয়েছে।
আরও শুনুন:
দুর্গাপুজো করেন মুসলিম পুরোহিত! ৬০০ বছরের পুরনো মন্দিরে এমনই নিয়ম
চালচিত্রের বিষয়বস্তুও কিন্তু একটা বড় ব্যাপার। বিষয়বস্তু হতে পারে অনেক কিছুই। যেমন, শিবদুর্গা, কৈলাস, শিব অনুচর নন্দীভৃঙ্গী, মহিষাসুর বধ, দশাবতার ইত্যাদি। উদাহরণ হতে পারে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির রাজরাজেশ্বরী দুর্গা প্রতিমা। এখানকার চালচিত্রে মাঝখানে থাকেন পঞ্চানন শিব। পাশে পার্বতী। তার একপাশে দশমহাবিদ্যা ও অন্য পাশে দশাবতার।
এই চালচিত্রের সঙ্গে বাংলার প্রতিমা নির্মাণ ধারার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। বাংলায় সাধারণত দুটি ধারার প্রতিমা নির্মাণ হয়ে আসছে। বিষ্ণুপুর রীতির প্রতিমা ও কংসনারায়ণ রীতির প্রতিমা। বেশি জনপ্রিয় কংসনারায়ণ রীতির প্রতিমাই। যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল চালচিত্র। অথচ দিনে দিনে কমে আসছে সেই চালচিত্র-শিল্পীর সংখ্যাই। যাঁরা টিকে আছেন তাঁরা কোনও রকমে পেটের দায়ে ধরে রেখেছেন প্রাচীন এই শিল্পধারাকে।
শুনে নিন বাকি অংশ।