তেইশের শারদ-বন্দনায় শহরে দাপিয়ে বেড়ালেন বছর ৩৫-৩৬-এর এক যুবক। তিনি এক এবং অদ্বিতীয় সুকুমার রায়। নানা কারণে বেপথু বাঙালিকে যেন তিনিই অমোঘ ইন্দ্রজালে ফিরিয়ে আনলেন বাঙালিয়ানার মোকামে। আর বাঙালির মন, ভাবনা, রসবোধ, রাজনৈতিক চিন্তায় শান দেওয়ার বার্তাটিও সেই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল সঙ্গোপনে, কিংবা প্রকাশ্যেই। সুকুমারের জন্মদিনে বাংলা ও বাঙালির সেই চালচিত্রটিকেই ফিরে দেখলেন সুলয়া সিংহ।
‘পথিক! তুমি পথ হারাইয়াছ?’- পদে পদে দিকভ্রষ্ট বাঙালির অন্তরে এ-প্রশ্ন যেন ক্ষণে ক্ষণে অট্টহাসির মতোই বেজে ওঠে আজকাল। হালফিলে না আছে তার পকেটে তেমন রেস্ত! না আছে সংস্কৃতি নিয়ে জবর হেস্তনেস্ত! অতএব ভুল বাংলা বানানে শহরের মুখ ঢেকে গেলে আগ্রাসনের অভিযোগ-আধুলিকেই সে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, আর ভাবে, পথের শেষ কোথায়! সে-দীর্ঘনিঃশ্বাস থেকে বাঙালিকে যেন মুক্তি দিলেন সুকুমার রায়। অনেক দিন পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাঙালি যেন অনুধাবন করল, না, তার গেছে যে দিন, তা একেবারেই যায়নি।
এবারের পুজোর কথাই ধরা যাক। ‘পিপল’স চয়েস’ হোক কিংবা ‘ক্রিটিক্স্ অ্যাওয়ার্ড’! তেইশের শারদ-বন্দনায় শহরের ‘শো-স্টপার’ হাতিবাগান নবীন পল্লির ‘আবোল তাবোল’। পুজোর আমেজে মণ্ডপে গিয়ে অসম্ভবের ছন্দেতে হারিয়ে যাওয়ার এমন সুযোগ, বাঙালি চেটেপুটেই উপভোগ করেছে। এমনটা হওয়া একদিক থেকে খুব স্বাভাবিকই। আবার অস্বাভাবিকও বটে। সুকুমার রায়কে শিশুপাঠ্যে বন্দি করে রাখার যে চলতি ছক, তা বলতে গেলে বাঙালির এক রকম স্বখাত-সলিলে ডুব। সুকুমার-সাহিত্যের পরতে পরতে যে রাজনৈতিক মাত্রা, রসবোধের আড়ালে ক্ষমতার প্রতি যে ক্ষুরধার সমালোচনা, তা এই তকমার জন্য অনেকটাই আড়ালে চলে গিয়েছে। হয়তো বিদ্যায়তনিক চর্চায় সেই গুরুত্ব নানা ভাবে স্বীকার করা হয়েছে। তবে, ননসেন্স-এর প্রগাঢ় চেতনা বাঙালির কাছে যে সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি, তা বলাই যায়। গোদের উপর বিষফোড়া হল সময় বদলে অধুনা শৈশবের আমূল বদলে যাওয়া। তার বহু কার্যকারণ আছে, বাঙালি তা নিয়ে চুলচেরা আলোচনাও করে বটে, তবে গ্রহণযোগ্য কোনও সমাধানের পথ পায়নি। আজকের শিশুরাও তাই সুকুমারের সঙ্গে সেভাবে পরিচিত নয়। এই যখন অবস্থা, তখন বাঙালির পুজো- যা এক সাংস্কৃতিক উদযাপন, সেখানে রীতিমতো রাজত্ব করলেন সেই সুকুমার রায়।
শৈশবের বইয়ের পাতায় পড়া চরিত্রকে জীবন্ত দেখে বাঙালি স্বভাবতই উৎফুল্ল। এমনকী যে শৈশবের সঙ্গে তাঁর এতদিন পরিচয় হয়নি, তাদেরও হল সুকুমারে হাতেখড়ি। পুজো ফুরিয়ে একাদশীর দিন গিয়েও মানুষ ডুব দিয়েছে সুকুমারের দুনিয়ায়। হাতিবাগান নবীন পল্লির মুখ্য আয়োজক দীপ্ত ঘোষ জানাচ্ছেন, সুকুমারকে শ্রদ্ধা জানানোর প্রয়াস তাঁরা নিয়েছিলেন, তবে, তা যে বাঙালিকে এতখানি উদ্বেল করে তুলবে, তা তাঁরা কল্পনাও করেননি। তবে, অন্য একটা প্রাপ্তিও আছে। দীপ্ত জানাচ্ছেন, “বিরাশি বছরের এক বৃদ্ধা এসে আমাদের প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেছেন। পুজোর সূত্রে বাঙালি যে এভাবে সুকুমারকে স্মরণ করেছেন, তাতে তিনি খুব খুশি। এছাড়া বহু মানুষ এসে মণ্ডপ ঘুরে দেখে যাবার সময় জানিয়ে গিয়েছেন যে, তাঁরা আবার সুকুমার রায়কে নতুন করে পড়বেন। যদি সত্যিই মানুষ আবার ‘সুকুমার সমগ্র’ পড়েন, সেটাই হবে আমাদের কাছে বড় অর্জন।” পুজো ফুরিয়েছে। তবে, হাতিবাগান নবীন পল্লির সুকুমার-স্মরণ অবশ্য ফুরোচ্ছে না। ২০২৩-এর ৩০ অক্টোবর সুকুমার রায়ের ১৩৬তম জন্মদিনে কমিটির সদস্যরা সুকুমার রায়কে উদযাপন করবেন। পুজো উপলক্ষে, সুকুমারের যে আবক্ষ মূর্তিটি তৈরি করা হয়েছিল, তা পাকাপাকি ভাবেই ওই চত্বরে রেখে দেওয়া হবে বলে জানালেন দীপ্ত।
আর আমবাঙালির সুকুমার-স্মরণ? তা কি পুজো উন্মাদনার সঙ্গেই ফুরিয়ে যাবে! এ প্রশ্নও এবার বড় হয়েই দেখা দিচ্ছে। পুজোর আমেজে যখন সুকুমারকে ফিরে পাওয়া গেল, তখনই যেন মনে পড়ল, বহুদিন নানা অছিলায় তাঁকে আমরা ভুলেই ছিলাম। সুকুমারীয়-দর্শনের মাঞ্জায় তেমন করে শান দেওয়ার আগ্রহী হয়নি বাঙালি-মনন। অথচ যে সময়টার ভিতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি, সেই রাজনৈতিক দৈন্যের ভিতর, সেই স্বাধীনতা হারানো একুশে আইনের যুগে, সুকুমার আমাদের কাছে আরও নতুন মাত্রায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। সেই যে কবীর সুমন গেয়েছিলেন, ‘আমাকে ভাবায়, সুকুমার রায়’- তার থেকে বড় সত্যি বোধহয় আর কিছু হয় না। সুকুমার রায় আমাদের শুধু মাতিয়ে রাখেন না, ফিরিয়ে দেন ভাবনার পথেও। ফিরিয়ে দেন আত্মবিশ্লেষণের দুনিয়ায়। সেই প্রশ্নোত্তর না পেরোলে নতুন পথের সন্ধান পাওয়া মুশকিল। অর্থাৎ, সত্যি বলতে অবরুদ্ধ দিনকালে সুকুমার আমাদের মুক্ত ভাবনার আশ্রয়, নিজেকে চেনার অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয়। পুজোর শহর যখন সুকুমারের হাত ধরেই বাঙালিয়ানার ঘাটে ফিরতে চাইল, তবে এবার প্রতিদিনের ভাবনা-যাপনেও হোক সুকুমার-উদযাপন। নইলে সবটুকুই সাময়িক হয়ে দাঁড়ায়। বাঙালির একজন সুকুমার রায় আছেন, এর থেকে বড় সৌভাগ্যের আর কিছু হয় না। আর ক্ষণিকের উত্তেজনা ছাড়া যদি আমরা তাঁকে মনে না রাখি, তার থেকে দুর্ভাগ্যেরও বোধহয় আর কিছু হবে না।
ছবি: শুভ্ররূপ বন্দ্যোপাধ্যায়