একসময় ভোট দেওয়ার অধিকারই ছিল না মেয়েদের। কিন্তু ক্রমশ শিক্ষা আর সচেতনতা যত বেড়েছে, মেয়েরা সে অধিকার পেতে সরব হয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল সে আন্দোলন। আর এই দাবিতেই বাঙালি মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আজকের দিনে মেয়েরাও ভোট দেবেন, এ কোনও নতুন কথা নয়। বরং ভোটের রাজনীতিতে মহিলা ভোটাররা দিনে দিনে দামি হয়ে উঠেছেন রাজনীতিকদের কাছে। যে কোনও রাজনৈতিক দল ভোটের ইস্তাহারে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন, তা দেখলেই স্পষ্ট হয় যে, মেয়েদের জন্য আলাদা করে কিছু সুবিধার কথা ভাবছেন তাঁরা। মেয়েদের জীবনকে সুগম করার বিষয়টি সারাবছর তাঁদের ভাবনায় থাকে কি না, সে প্রশ্ন অবশ্য আলাদা। তবে ভোটের বাজারে মেয়েদের হাতে টাকা দেওয়া, কিংবা রান্নার জ্বালানির ব্যবস্থা করার কথা তাঁদের ভাবতেই হয়। কেননা এইসব ‘মেয়েলি’ সুযোগ সুবিধা যে ভোট টানার ক্ষেত্রে তুরুপের তাস হয়ে উঠছে, সে কথা এখন সকলেরই জানা। কিন্তু বরাবর বিষয়টি তো এমন ছিল না। ভোট দেওয়ার অধিকারই ছিল না মেয়েদের। কিন্তু ক্রমশ শিক্ষা আর সচেতনতা যত বেড়েছে, মেয়েরা সে অধিকার পেতে সরব হয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল সে আন্দোলন। আর এই দাবিতেই বাঙালি মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আরও শুনুন:
দেশের প্রথম নির্বাচনে ভোট দেওয়া হয়নি ২৮ লক্ষ মহিলার, কিন্তু কেন?
না, কেবল ভোটাধিকার সামাজিক মঙ্গলের নিঃশর্ত উপায় হতে পারে না বলেই মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ। ব্যক্তিমানুষের মাথা পিছু একটি ভোটের অধিকারই কি তার সমস্ত সমস্যার নিরাময় করতে পারে? তা তো নয়। জীবনে যাবতীয় সংকটের সুরাহা করতে চাইলে আগে মানুষকে তার নিজের অধিকার ও অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন হতে হয়। পল্লিগ্রামের প্রজাদের দুরবস্থার কথা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘এক সময় লোকে মনে করিয়াছিল আপামর সাধারণকে ভোট দিতে দিলেই পৃথিবীর অধিকাংশ অমঙ্গল দূর হইবে– এখন সকলে ভোট দিতেছে, অথচ অধিকাংশ অমঙ্গল বিদায় লইবার জন্য কোনোরূপ ব্যস্ততা দেখাইতেছে না।’ তাই রবীন্দ্রনাথ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘নিজেকে এই-যে বাঁচাবার শক্তি তা জীবনযাত্রার সমগ্রতার মধ্যে, কোনো একটা খাপছাড়া প্রণালীতে নয়। তা বিশেষ আইনে নয়, চরকায় নয়, খদ্দরে নয়, কন্গ্রেসে ভোট দেবার চার-আনা ক্রীত অধিকারে নয়।’ কিন্তু মেয়েদের অধিকার মেয়েদের আদায় করে নিতে হবে, এও বুঝেছিলেন তিনি। অধিকার বলতে কেবল শিক্ষা বা বিধবা-বিবাহের আইনি অধিকার নয়, অস্তিত্ব ও মর্যাদারক্ষার জন্য মেয়েদের পেতে হবে আরও গভীরতর অধিকার- এ বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের ছিল। কিন্তু সেই গভীরতর অধিকারের কথা নাহয় থাক, মেয়েরা যখন ভোটাধিকারের মতো একেবারে বাস্তব এক অধিকার দাবি করে বসলেন, সেই অধিকারকেও সংগত বলেই বোধ হয়েছিল তাঁর।
সে ঘটনা ঘটেছিল ১৯২১ সাল নাগাদ। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশনে সেদিন প্রচণ্ড উত্তেজনা। ততদিনে বিদেশি শাসকদের দরবারে গিয়ে মেয়েরা দাবি তুলেছিলেন, ভোট দেবে মেয়েরাও। আইরিশ মেম মার্গারেট কাজিন্স ভারতে টেনে এনেছিলেন সাফ্রাজিস্ট আন্দোলনকে। মাদ্রাজে গড়ে তুলেছিলেন Women’s Indian Association। WIA-ই সম্ভবত প্রথম নারীবাদী সংঘটন, যে সংগঠন ভারতীয় মেয়েদের উন্নতির জন্য বিবিধ প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। তার মধ্যে ছিল ভোটাধিকারও। লন্ডনে গিয়েও মেয়েদের ভোটদানের সপক্ষে সওয়াল করেছিলেন সরোজিনী নাইডু, হীরাবাই টাটা, আর অ্যানি বেসান্ত। তাঁদের হাত ধরেই ভোট দেওয়ার অধিকার মেয়েরা ছিনিয়ে নিলেন বটে, তবে নির্দিষ্ট আয়ের সম্পত্তি না থাকলে তখন পুরুষ-নারী কেউই ভোট দিতে পারত না। তবুও, অধিকার তো বটে। ১৯২১ সালেই বোম্বাইয়ে ভোটের অধিকার পেয়েছেন মেয়েরা। এর আগেই, ১৯১৯-এ মাদ্রাজ শহরের মেয়েরা লাভ করেছিলেন এই অধিকার, ভারতে প্রথমবার। কিন্তু বাঙালি মেয়েদের ভাগ্যে সেটুকুও জোটেনি তখনও। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার ওপরেই সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব চাপিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।
আরও শুনুন:
যে রাঁধে সে রাজনীতিও করে! ভোটের হাওয়ায় পলিটিক্সের হেঁশেলনামা
আসলে ১৯২১ সালেই, ১৩ অগস্ট, ভোটাধিকারের সপক্ষে আরও সুর চড়াতে ‘বঙ্গীয় নারী সমাজ’ তৈরি করেছিলেন মেয়েরা। এর সভাপতি নির্বাচন করা হয় অবলা বসুকে। থিওজফিকাল সোসাইটির হলে নারী সমাজের এক সভায় মেয়েদের পাশে দাঁড়ালেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। পাশে ছিলেন রবীন্দ্রনাথও। এরপর ৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশনে ভোটাভুটি হয়, মেয়েরা ভোটদানের অধিকার পাবেন কি না, তা নিয়ে। কিন্তু বিপক্ষে গেল ৫৬ ভোট, আর ৩৭ ভোট এল মেয়েদের ভোট দেওয়ার পক্ষে। মেয়েদের ভোটাধিকারের প্রস্তাব খারিজের দলে ছিলেন শহিদ সোহরাওয়ার্দিও। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘বাংলার মেয়েরা কী এমন করেছে যে দেশ পুনর্গঠনে অংশ নেওয়ার দাবি তুলছে তারা?’ এর পালটা ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় সুলতানা মোয়াজ্জেদা লিখলেন, ‘এই প্রদেশের নারীরা, বিশেষভাবে মোহামেডান গোষ্ঠীর সদস্যরা, ব্যবস্থাপক সভায় নির্মমভাবে সমালোচিত হয়েছেন এবং অনবরত অভিযুক্ত হচ্ছেন যে, তাঁরা এমন কোনো সামাজিক কর্ম সম্পাদন করেননি যা তাঁদের ভোটদানের অধিকারী করতে পারে। কিন্তু তাঁদের পশ্চাদপদ অবস্থার জন্য কাদের আমরা দায়ী করতে পারি? মিস্টার সোহরাওয়ার্দী জানতে চেয়েছেন, তাঁদের অশিক্ষিত করে রাখতে চায় কে? এটা বলা অসঙ্গত হবে না যে, সেটা চায় পুরুষেরা, বিশেষত আমাদের সুযোগ্য বিরুদ্ধাচারীর মতো পুরুষেরা, যাঁরা বাস্তবে এই প্রদেশের নারীর অবস্থা পরিবর্তন প্রচেষ্টার বিরোধী।’
যুক্তিগুলো অগ্রাহ্য করা কঠিন ছিল। তবু, সংস্কার কি আর সহজে যায়! মেয়েদের লড়াই অবশ্য একেবারে বৃথা যায়নি। ১৯২৩-এ মেয়েদের এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন লর্ড লিটন। সেই বছরই বাংলার মেয়েরা লাভ করলেন পুর নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার। আর ১৯৫০ সালে, স্বাধীন দেশে প্রথম নির্বাচনের শরিক হন মহিলারা। সেই অধিকারের পথ খুলে দিয়েছিলেন পরাধীন ভারতের সেই মেয়েরাই, ভোটাধিকার জন্য যাঁরা লড়াই করতে পিছপা হননি।