‘দুর্গেশনন্দিনী’ থেকে ‘মৃণালিনী’, ‘রাজসিংহ’ থেকে ‘আনন্দমঠ’, বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা একাধিক উপন্যাসই মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে হিন্দু বীরের লড়াইয়ের আখ্যান। ততদিনে বাংলায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের যে নির্মাণপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে, তার অংশ হয়ে উঠছে এই লেখালিখি। কিন্তু আজকের দিনে হিন্দুত্ব বিষয়টি যে অর্থে প্রযুক্ত হয়, বঙ্কিমচন্দ্রের জাতিবোধ কি ঠিক সেই হিন্দুত্বের কথাই বলে?
সাম্প্রতিক কালে দেখা গিয়েছে, বাংলায় হিন্দুত্ব প্রচারের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে একরকম ভরকেন্দ্র ঠাওরেছে বিজেপি। বিজেপির বঙ্কিমজয়ন্তী পালন উপলক্ষে কলকাতায় এসে হিন্দুত্ব বা ‘হিন্দু সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’-এর উৎস হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রকেই চিহ্নিত করেছিলেন খোদ অমিত শাহ। সত্যি বলতে, বঙ্কিমচন্দ্রের লেখালিখিতে এমন অনেক উপাদান মিলেও যায়, যা থেকে তাঁর সঙ্গে হিন্দুত্বের যোগ টানা যায় সহজেই। একদিকে তাঁর বন্দেমাতরম গান জাতীয়তাবাদের ভিত্তি গড়েছিল। আবার সেই গান রয়েছে যে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে, সেই উপন্যাসেরই নানা বক্তব্য সরাসরি মুসলিম জাতিকে নিশানা করে। আর তার জেরেই বঙ্কিমচন্দ্রকে সংকীর্ণ হিন্দু জাতীয়তাবাদের মূর্তি হিসেবে দেখার অভ্যাসও রয়েছে। কিন্তু আজকের দিনে হিন্দুত্ব বিষয়টি যে অর্থে প্রযুক্ত হয়, বঙ্কিমচন্দ্রের জাতিবোধ কি ঠিক সেই হিন্দুত্বের কথাই বলে?
তাহলে সেই সময়কার জাতীয়তাবাদের ধরনটিকে খানিক বুঝে নেওয়া দরকার, আর সেই প্রেক্ষিতেই যাচাই করতে হয় বঙ্কিমচন্দ্রকেও।
-: আরও শুনুন :-
ভোটপ্রচারে নিন্দেমন্দের শেষ নেই! সভায় কথা বলবেন কোন রীতিতে, শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ
বঙ্কিম যে সময়ের মানুষ, সে সময়ে ইংরেজি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়েছে বাংলায়। যে আলো আন্তর্জাতিক আধুনিকতাকে চিনতে শেখাচ্ছে, একইসঙ্গে নিজের ঐতিহ্যকেও খুঁজতে বলছে। সেই বোধ থেকেই উনিশ শতকে বাংলায় জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ ঘটছিল। দেখা যাবে, এই জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গে হিন্দু শব্দটি বারবার ঘুরেফিরে আসে। হিন্দুমেলা, হিন্দু থিয়েটার, এমন নানা নামকরণের মধ্যে দিয়ে জাতীয় বিষয় বোঝানো হতে থাকে। তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এই হিন্দুত্ব আসলে ঠিক আজকের ধর্মীয় হিন্দুত্ব নয়। হিন্দুস্থানের বাসিন্দা যে হিন্দুরা, সেই দেশ ও জাতির গৌরবকে তুলে ধরার কথাই এখানে বলা হচ্ছিল। আসলে ভিনদেশ থেকে এ দেশের উপর আক্রমণ আগেও হয়েছে। শক, হুন, গ্রিক- এমন নানা জাতির আক্রমণ নেমেছে তার মাটিতে। কিন্তু তুর্কি আক্রমণে রাতারাতি এ দেশের অন্তরমহল বদলে গিয়েছিল। পরবর্তী কালে পাঠান, মুঘল শাসনেও সেই অস্বস্তি কাটেনি। কিন্তু ইংরেজ শাসনে যে আধুনিকতা এ দেশে এল, তার আঁচ পাওয়া শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ইংরেজকে কেবল শত্রু বলে ভাবতে পারছিলেন না। একা বঙ্কিম কেন, উনিশ শতকের কোনও মনীষীই তা পুরোপুরি পারেননি। ফলে ইংরেজের চেয়ে মুসলিম শাসকের মূর্তিটিই তাঁরা বেশি করে নাকচ করতে চেয়েছিলেন। এ মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি ব্যক্তিগত ঘৃণা নয়, মুসলিম শাসকের অত্যাচার ও প্রাচীনপন্থী শাসন প্রত্যাখ্যানের ইতিহাস। বঙ্কিমের হিন্দু পুনরুজ্জীবনের ভাবনা তাই আজকের হিন্দুত্ববাদীদের, ‘মনুবাদী’দের থেকে অনেক আলাদা। হিন্দুত্বে আস্থা রেখেও, সে দর্শন গভীর ও ব্যাপক।
দেখা যাচ্ছে, ‘দুর্গেশনন্দিনী’ থেকে ‘মৃণালিনী’, ‘রাজসিংহ’ থেকে ‘আনন্দমঠ’, বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা একাধিক উপন্যাসই মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে হিন্দু বীরের লড়াইয়ের আখ্যান। ততদিনে বাংলায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের যে নির্মাণপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে, তার অংশ হয়ে উঠছে এই লেখালিখি। আগেই বলা হয়েছে, সে জাতীয়তাবাদ বীরত্বের ইতিহাস খুঁজছিল, যে বীরত্বে ভর করে দেশ আত্মবলে ভর করতে পারে। সে ইতিহাসে পাঠান বা মুঘলের সঙ্গে রাজপুতের লড়াই, সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ইতিহাসই তো রয়েছে। সে ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধ ছাড়া, সদ্য আসা ইংরেজের সঙ্গে লড়াইয়ের তেমন সূত্র কোথায়! ফলে বাঙালির তথা ভারতের ইতিহাস নির্মাণ করতে গিয়ে সেই পুরনো বীরত্বকেই অবলম্বন করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র।
-: আরও শুনুন :-
জাত অর্থে ধর্ম নয়, বাঙালি পরিচয়েই ভরসা সত্যজিতের
‘আনন্দমঠ’-এর প্রথম পাঠে অবশ্য বলা হয়েছিল, ‘মার মার ইংরেজ মার’। কিন্তু মনে করা হয়, ইংরেজ প্রভুর রোষ এড়াতেই পরের সংস্করণে ‘ইংরেজ’ বদলে ‘যবন’ করে দেন বঙ্কিম। এ উপন্যাসের পটভূমি হল ১৭৭২-এর সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। সেসময় পলাশির যুদ্ধ শেষ হয়েছে। মিরজাফর আর ইংরেজদের অত্যাচারে বাংলায় অরাজক অবস্থা। মেয়ে, বউ, ছেলেকে বিক্রি করে পেটের ভাত জোটাতে চাইছে মানুষ। নারীপুরুষের মৃতদেহ শিয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খাচ্ছে। সেই সময়ে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমিকায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানুষকে সংগঠিত করার ডাক দিচ্ছেন একদল সন্ন্যাসী। ধর্মকে ঘিরেই তাঁদের জীবন, সুতরাং মানুষকে একসঙ্গে বাঁধার সুতো হিসেবেও তাঁরা ধর্মকেই দেখবেন, এ তো স্বাভাবিকই। ফলে বন্দেমাতরম গানে বা গোটা আনন্দমঠ উপন্যাসেই দেশকে মা বলা নিয়ে যে পৌত্তলিকতার অভিযোগ তোলা হয়, উপন্যাসের কাহিনির প্রেক্ষিতে তা কিন্তু তেমন অসংগত থাকে না। আবার, সে কাহিনি যে সময়কালে, ইংরেজ তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে শাসক নয়। ফলে তারা লুঠ করে, কিন্তু এখানকার ধর্ম বা সামাজিক রীতিনীতিতে বিশেষ নাক গলায় না। কিন্তু ভিনদেশ জয় করে তা সর্বতোভাবে অধিকার করার জন্যে মুসলিম শাসকদের অনেকেই ভিন্ন মত ভিন্ন ধর্ম ভিন্ন জাতি সবকিছুকেই দমন করতে চেয়েছেন। ফলে মন্দির ধ্বংস হয়েছে, হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর বসেছে, ধর্মান্তরও ঘটেছে। সেই বিপন্নতা থেকে যে বিদ্রোহ দানা বাঁধছে, সেখানে অত্যাচারিত, বিদ্রোহী চরিত্রগুলির সংলাপে মুসলিম-বিদ্বেষ থাকাও অস্বাভাবিক নয়। এই বিদ্বেষ আসলে সাধারণ মুসলিমদের প্রতি নয়, মুসলিম শাসকদের প্রতিই। কিন্তু ইংরেজ না বলে ‘ব্রিটিশ’ বলে যেমন শাসক বোঝানো যায়, ইসলাম শাসন-কাঠামোকে তেমনটা বলার সু্যোগ নেই। তাই ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে ‘মুসলমান’ শব্দটিই বারবার ফিরে এসেছে।
ইদানীং কালের হিন্দুত্বে মুসলিম ধর্মপরিচয়ের প্রতিই সুগভীর বিদ্বেষ জাঁকিয়ে বসছে। সেখানে মুসলিম গোষ্ঠীর প্রতি সংরক্ষণের প্রস্তাবে, তাদের সুযোগসুবিধা দেওয়ার প্রকল্পে পালটা আক্রমণের ঝড় বয়ে যায়। অথচ বঙ্কিম কিন্তু দেশের যাবতীয় ‘শ্রীবৃদ্ধি’-র প্রেক্ষিতে প্রশ্ন করতে পেরেছিলেন, এই ‘আচ্ছে দিন’-এর উপভোক্তা আসলে কারা? হিন্দু এবং মুসলিম উভয়কেই দেশের সমৃদ্ধির শরিক বলে গণ্য করেছেন তিনি, আর তাই ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, “হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্ত্ত দুই প্রহরের রৌদ্রে, খালি মাথায়, খালি পায়ে এক হাঁটু কাদার উপর দিয়া দুইটা অস্থিচর্ম্মবিশিষ্ট বলদে, ভোঁতা হাল ধার করিয়া আনিয়া চষিতেছে, উহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে?” এ প্রশ্ন করতে পারেন বলেই বোঝা যায়, বঙ্কিমচন্দ্রের হিন্দুত্ব নিছক কোনও দেবতার জয়ধ্বনি নয়, কোনও সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ নয়। বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তা তার চেয়েও বড় কিছু। যে বঙ্কিম ধর্ম্মতত্ত্ব, উত্তরচরিত, কৃষ্ণচরিত্র লেখেন, তিনি আসলে তাঁর লেখনীতে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বের ধ্বজা উড়িয়ে দেন না, তিনি হিন্দু অর্থে দেশবাসীকে বুঝে দেশের প্রাচীন জ্ঞান-বিদ্যা-ধর্মের সম্পদকে খুঁজতে চান। সেই ব্যাপক জাতিচেতনাকে ঘিরে ধর্মপরিচয়ের বেড়া তুলতে চাইলে তা বঙ্কিমচন্দ্রকে ভুল-বোঝাই হবে। আর সেই ভুলের ফাঁদে পড়ে বঙ্কিমচন্দ্রকে কেবল ‘হিন্দুত্বে’র তকমা দিলে আদতে ক্ষতি হবে আমাদেরই।