ভারতীয় ফুটবলে এককালে চুনী-পিকে-মান্নাদের বাঙালিরাজ ছিল। অথচ আজ ক্রিকেট হোক কি ফুটবল, বঙ্গ-মুখের দেখা মেলা ভার। অন্য খেলায় বাংলার যে ছেলেমেয়েরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁরাও অনেকেই চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন অন্য রাজ্যে। সৌজন্যে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। পয়লা বৈশাখে ময়দানি হালখাতায় ‘বউনি’র আগে পুরনো হিসেব-নিকেশে চোখ বোলালেন সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়।
অলংকরণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
দেশে তো বটেই, বাংলাতেও ‘ময়দান’ রিলিজ করেছে। আপনি দেখেছেন তো?
বাঙালি হিসেবে যদি এখনও দেখে না থাকেন, মস্ত ভুল করেছেন। কারণ, দেখার যেটুকু বাসনা বাঁচিয়ে রেখেছেন তা মাঠে মারা যেতে পারে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাসমান বঙ্গজ-তর্কলঙ্কারদের ‘ফিল্মি’ সমালোচনার গুঁতোয়। আজকাল ‘ক্রিটিক’ কেরামতিতে সিনেমা হলে পায়ের ধুলো দেওয়ার আগেই আপনি টের পেয়ে যাবেন, সিনেমা আদৌ দেখার ‘উপযুক্ত’ কি না। এই যেমন, ‘ময়দান’-এ কেন চুনী গোস্বামীর চরিত্রটি পিকে-কে ‘পিকেদা’ বললেন, সেই গর্হিত পাপ নিয়ে তরজা; কিংবা ধরুন, চুনীর চরিত্রে অভিনয় করা অমর্ত্য রায়কে কেন আর একটু ‘ফ্ল্যামবয়েন্ট’ করা হল না, ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে শিরায় শিরায় যে ঋত্বিক-মৃণাল-সত্যজিতের রক্ত বইছে, সেটা মনে করিয়ে দেওয়াটা বাঙালির মজ্জাগত। কত কাঠখড় পুড়িয়ে ‘ময়দান’ দিনের আলো দেখল, কিংবা সিনেমার প্রাণপুরুষ যিনি, সেই ’৬২-এর এশিয়াডের ভারতীয় দলের কোচ রহিম সাহেবকে আমরা পরবর্তী সময়ে কতটা মনে রাখতে পেরেছি, সেটা মোটেই বিচার্য নয়। বিচার্য নয়, তাঁর হাতে তৈরি ভারতীয় ফুটবলের ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর’ চুনী-পিকে-বলরামকে আমরা যোগ্য সম্মান দিতে পেরেছি কি না।
এ বিষয়ে অবশ্য বাঙালির কোনও দোষ নেই। ইতিহাস সাক্ষী, বাঙালি বরাবরের আত্মবিস্মৃত জাতি। তাই চক্ষুলজ্জা নিষ্প্রয়োজন। বরং শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। বিশ্বকাপ জয় নিয়ে তৈরি কপিলের ‘৮৩’ চলেনি, ‘ময়দান’ সেখানে কার্যত ভারতীয় ক্রীড়ার ‘সত্যযুগ’, আজকের ‘বং’ জেনারেশন তা ‘খাবে’ তো? প্রশ্নব্যাকুল হয়ে পড়েছে স্বয়ং বঙ্গসমাজ।
বং-কুলেরই বা দোষ কী! তারা চোখের সামনে দেখছে, পেট্রোলের দামকে টেক্কা দিয়ে ফিফা ক্রমতালিকায় ভারতীয় ফুটবল পৌঁছে গিয়েছে ১২১-এ! আফগানিস্তান, বাংলাদেশকে হারাতে আলজিভ বেরিয়ে পড়ছে ‘ব্লু টাইগার’-দের। সেই টিমে বাঙালি মুখ কজন? খুঁজে বের করতে রীতিমতো দূরবীন নিয়ে বসতে হয় স্টেডিয়ামে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ফুটবলপ্রিয় আজকের বাঙালি-মন কীভাবে অনুধাবন করবে, এককালে ভারত কী ছিল, আজ কী হইয়াছে?
শোনা কথা, পাঁচ-ছয়ের দশকে বিশ্বফুটবলের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে ভারতীয় ফুটবল। ফ্রান্সের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়েছে, হেলায় হারিয়েছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াকে। আজকে সেসব দিবাস্বপ্ন হলেও অতীতে সেই দাপটকে নেতৃত্ব দিতেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে শৈলেন মান্না, সমর ওরফে বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনী গোস্বামী, পিকে অথবা প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় নামগুলো ছিল অগ্রগণ্য। অর্থাৎ বাঙালিরাজ ছিল ভারতীয় ফুটবলে। এখন সেখানে কোটিতে গুটিক। ক্লাব ফুটবলে শিবরাত্রির সলতে হয়ে যাঁরা জ্বলছেন, তাঁরাও হালে পানি পাচ্ছেন না জাতীয় দলে, এমন দশা!
বাঙালির অবশ্য সেসব নিয়ে এত মাথা ঘামানোর সময় নেই। তাদের মোহনবাগান আছে, ইস্টবেঙ্গল আছে। পারস্পরিক আকচাআকচি আছে। এই তো ব্যর্থতার অতল থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে এবার সুপার কাপ জিতে মরশুম শেষ হল ইস্টবেঙ্গলের। আইএসএলের ‘সুপার সিক্স’ নাই বা হল। লাল-হলুদ জনতা অল্পেতেই খুশি। প্রথম এগারোয় সৌভিক, সায়নদের সংখ্যাটা কেন বাড়ে না, তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তাদের বয়েই গেছে, দেশের জার্সিতে ‘বাঙাল-ব্যাটা’র দাপট কেন কম, সে নিয়ে ভাবতে। সামনের মরশুমে আরও ভালো দল চাই, ভালো বিদেশি চাই, কিন্তু দলে বাঙালির ফুটবলার আরও বাড়ুক, ভরসা করে সে দাবি তুলতে মশাল জনতার বোধহয় আজকাল কণ্ঠ কাঁপে।
পড়শি ক্লাবেও ছবিটা উনিশ-বিশ। বরং আরও বেশি করুণ। ৭০ কোটির টিমের আইএসএল শিল্ড না জিতলে নাক কাটা যাবে, তাই সেটাকে পাখির চোখ করে প্রাণপণ ছুটছে পালতোলা নৌকা। কিন্তু সেই লড়াইয়ে বাঙালির অবদান নেহাতই নগণ্য। একমাত্র শুভাশিস বোস ছাড়া প্রথম এগারোয় নিয়মিত কোনও বঙ্গ-মুখ নেই, বাকি যাঁরা রয়েছেন তাঁরা অনিয়মিত। অথচ সামনেই নববর্ষ। হাল-খাতায় দাগ কাটার আগেই ময়দানে বারপুজোয় রইরই পড়ে যাবে দুই প্রধানে। সমর্থকদের মন রাখতে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইবে কর্মকর্তাদের গলায়, পড়শি ক্লাবকে বিঁধে থাকবে পয়লা বৈশাখে গা-গরম করা টোন-টিপ্পনী। সমর্থকরা মেপে নেবেন বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কর্তাদের সম্পর্ক কোন খাতে বইছে। ব্যস, এটুকুই! লুচি-পান্তুয়া কিংবা আমপোড়া শরবতের আমেজে ঢাকা পড়ে যাবে কর্কশ প্রশ্নটা– বাঙালি ফুটবলারদের সাপ্লাই লাইন তৈরি হচ্ছে না কেন? আরও বেশি করে বাঙালি ফুটবলার উঠে আসছে না কেন? বাংলার বুকে একটা শতাব্দীপ্রাচীন ফুটবল নিয়ামক সংস্থা আছে। আছেন কর্তারাও। এমন বিটকেল প্রশ্নে তাঁরা পরস্পরের মুখ চেয়ে থাকবেন নিস্পৃহ চিত্তে, সেটাই স্বাভাবিক। কারণ ইচ্ছা থাকলেও তাদের উপায় নেই। আসলে, বঙ্গ ফুটবল সংস্থার কর্তাদের স্বপ্ন থাকলেও সামর্থ্য অনেকটাই আদিগঙ্গার মতো। ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে।
বাঙালির এসব নিয়ে এত তলিয়ে ভেবে কাজ নেই। ফুটবল না হোক, তাদের ক্রিকেট আছে। সবচেয়ে বড় কথা, আছে আইপিএল। চৈত্রের মাঝামাঝি ‘উঠিল বাজনা বাজি’-র মতো আইপিএল হাজির নন্দনকাননে। বঙ্গসমাজ বেগুনি হয়ে তখন ইডেন মাতাতে মশগুল। কে কোন দল, তা নিয়ে না ভেবে ‘এনজয় গুরু’ বলে অন্তরাত্মাকে খুশি করলেই তাদের দায় মিটে যায়। খালি বিশ্বকাপ-টাপ এলে বাঙালির মনে পড়ে, দলে একটাও বঙ্গ-ক্রিকেটার নেই। অথচ বঙ্গ-ক্রিকেটে হাঁড়ির যে কী হাল, সেটা সারাবছর মনে থাকে না। রনজির গ্রুপ পর্বের বাধা পার করতে পারে না বাংলা টিম, সাফল্যের দেখা মেলে না সৈয়দ মুস্তাক আলি কিংবা বিজয় হাজারে-তে। আজ নয়, বছরের পর বছর ধরে এটাই ‘ট্রাডিশন’। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আবার যোগ হয় ময়দানি গড়াপেটা, এক্কেবারে খুলেআম চোখের সামনে। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে, অল্প অল্প করে খসে পড়ছে পলেস্তারা, বেরিয়ে পড়ছে বাংলা ক্রিকেটের কঙ্কালসার দশাটা। এসবের পর সৌরভতুল্য কোন ক্রিকেটার উঠে এসে ধুলোপড়া বঙ্গক্রিকেটের মলিনতা ঘোচাবেন, এমন আশা আসলে দুরাশা। বিচক্ষণ বাঙালি সে আশা করেও না। তারা শুধু খোঁজ রাখে, কেকেআর ম্যাচে ‘পাঠান’-এর পায়ের ধুলো ইডেনে পড়ছে কি না! ব্যস, তাহলেই হল– ক্রিকেট-তীর্থে মোক্ষলাভ, আর কী চাই!
পাঠক, নিশ্চয় ভাবছেন, অকথা-কুকথা বলে দিনটা মাটি করছি। ভাবচ্ছেন, এ ব্যাটা অলপ্পেয়ে নচ্ছার, খালি খুঁত খোঁজে, ভালো দেখতে পায় না। বলতেই পারেন, বাঙালির আজকাল ক্রিকেট-ফুটবল নয়, অন্যান্য স্পোর্টসও সমান তালে খেলে। শুটিংয়ে মেহুলি ঘোষ আছে, টেবল টেনিসে আছে ঐহিকা-সুতীর্থার মতো ট্যালেন্ট। স্বপ্না বর্মণ, প্রণতি কিংবা অতনু দাসরা কম গর্বিত করেছে নাকি বাংলাকে? আদ্রিয়ান কর্মকার, রেজওয়ানা মল্লিক হিনা, পয়মন্তী বৈশ্য, প্রতিষ্ঠা সামন্তের মতো কত নতুন মুখ উঠে আসছে। এসব কি নিছকই বাঙালির কল্পনাবিলাস?
একদমই না। কিন্তু এদের মধ্যেই অনেকেই আছেন, বাংলায় উপর্যুপরি পৃষ্ঠপোষকতা না পেয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছেন অন্য রাজ্যে। প্রতিনিধিত্ব করেছেন সে-রাজ্যের হয়ে। বাংলার ছেলে কিংবা মেয়ে বলে তাই যতই বাষ্পগদগদ হোন, আখেরে তাদের সাফল্যে বাংলার কোনও হাত নেই– এই নির্মম সত্য মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী!
এত কিছু এজন্য বলার, কারণ পয়লা বৈশাখ এসেছে। নববর্ষের আমেজ। ময়দানি হালখাতায় ‘বউনি’র আগে একটু পুরনো হিসেব-নিকেশে চোখ বুলিয়ে রাখা ভালো। নয়তো আফসোস বাড়বে। তাতে বাঙালির প্রেস্টিজে ফলিডল। দার্শনিকচিত্তে ময়দানি বটতলায় বসে তখন না আবার বলে, ‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?’
:আরও শুনুন:
বাঙালির হাল-খাতা : সাহিত্য আর আড্ডার সুতোয় বাঁধা পয়লা বৈশাখ
বাঙালির হাল-খাতা : বছরের সঙ্গে সঙ্গে কি বদলে গেল প্রেমের মনও?
বাঙালির হাল-খাতা : বঙ্গনেতাদের কথায় ফিরুক সৌজন্য
বাঙালির হাল-খাতা : হালখাতার সঙ্গে বাঙালির বছর শুরুর পুজোপাঠ
বাঙালির হাল-খাতা: স্মৃতির ভাঁড়ার হাতড়েই পাত বাড়ে বাঙালি