জিভে যতখানি স্বাদ, তাতে নুনঝাল জুড়ে দেয় স্মৃতির ফোড়ন। আর দুয়ে মিলেই পাত সাজায় বাঙালি। সেই সাজানো পাতে বাঙালির চিরবসত, বছর বদলালেও যে বসতের ঠিকানা সে ভোলে না। যতবারই তার বাস্তু হারাক না কেন, স্বাদ আর সাধের এ উত্তরাধিকার তার কাছ থেকে কেড়ে নেবে কে! বাঙালির সেই স্বাদকাহনের হাল-খাতায় নজর রাখলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
অলংকরণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
মানুষের একটা দেশ তার বাসভূমি, আরেকটা দেশ তার স্মৃতির ভুবন। সে স্মৃতি কেবল মনে থাকে না। চোখ-নাক-জিভে মেশা রূপ-রস-গন্ধ-স্বাদে উবুরচুবুর স্মৃতির ভাঁড়ার। রোজের বাজার ফুরিয়ে গেলে সে ভাঁড়ারে হাত ডুবিয়ে বের করে আনতে হয় ফেলাছড়া ব্যঞ্জন। কুড়িয়েকাঁচিয়ে বেরোয় একচিলতে মশলাও, যার নাম কাল। তারপর দুয়ে মিলে পাত বেড়ে দেয় মাধুকরীর অন্ন। বাঙালির ভাগ্যে আর কিছু থাক না থাক, তার সে গোপন ভাঁড়ার বাড়ন্ত হয় না।
যদিও তার স্মৃতি সততই সুখের নয়। ভিটেমাটিজমিপুকুরের দেশ ছেড়ে আসার সময় মাঠের ধান, গাছের ফল আর পুকুরের মাছ তাদের অনেকেই আনতে পারেনি কোঁচড়ে বেঁধে। আনতে পারেনি ভাত খাবার থালা আর কাঁঠালকাঠের পিঁড়িও। কিন্তু আঁচলে বাঁধা মুড়ির মধ্যে ঝাঁকুনি খেতে খেতে, পুঁটলির মধ্যে গুটিসুটি মেরে, ঘরের বউয়ের ঘোমটার তলে তলে বর্ডার পেরিয়ে চলে এসেছে একটুকরো ‘দ্যাশ’। জিভের ডগায় বয়ে আনা সেই স্মৃতি এত যুগ পরেও বাঙাল রান্না নিয়ে বড়াই করতে ছাড়ে না। তাতে পদ্মার ইলিশের ঝোল বা গোয়ালন্দ স্টিমার কারির কথা যত থাকে, তার চেয়ে বেশি করে থাকে হেলাফেলার হেঁশেলের গল্প। হাজারি ঠাকুরের সেই নিরামিষ চচ্চড়ির কথা মনে আছে? যখন রান্নাঘর ফাঁকা, তখন হতছেদ্দা করা বাঁধাকপির পাতা, কুমড়োর বীজওলা নরম গা, শাকের ডাঁটা, কাঁঠালের বীজ দিয়ে অমন স্বাদু ব্যঞ্জন রেঁধে ফেলা মাছেভাতে বাঙালি, থুড়ি বাঙালেরই মন্ত্রগুপ্তি। দ্যাশেঘরে ওসব ফেলাছড়া জিনিস পেতে তো ভাবতে হয় না। কতদিন পর তাই মণীন্দ্র গুপ্ত ‘আমাদের ভাঁড়ার’-এর কথা বলতে গিয়ে লিখে ফেলেন, “সকালবেলা দাদু কোনও দিন কাঁটায় ভরা বেতলতার জঙ্গল থেকে সবুজ একগোছা বেতের ডগা কেটে এনে নামিয়ে দিলেন রান্নাঘরে। বড়মা স্নান করতে গিয়ে ডুব দিয়ে দিয়ে তুললেন ফুলসুদ্ধ সজল শাপলা। ছোটমা আঁকশি দিয়ে পশ্চিমপুকুর থেকে টেনে টেনে নিয়ে এল কলমি আর হিঞ্চে। গিমে শাক, থানকুনি আর বিলিতি ধনেপাতা তো রান্নাঘরের ছাঁচতলায় হয়েই আছে। আমি খুঁটে খুঁটে তুলে আনতে পারি। এসব হল হাতের কাছে পাওয়া প্রথম ভোরের জিনিস।” অবশ্য রান্নার উপকরণ থইথই করলেও অপচয় বাঙালদের ধাতে নেই, তাই যা পাই তাই বেটে ফেলা, নইলে বড়ি-বড়া ভেজে ফেলাই তার স্বভাব। বনেজঙ্গলের খারকোল পাতা কিংবা কচুর বাটা, দুর্গন্ধে ভরা গাঁদাল পাতার বড়ার যে অমন তার হতে পারে, সে কথা কে-ই বা জানাত নইলে!
দেশ পেরিয়ে আসা স্মৃতির ফোড়ন-সম্বরায় বাঙালের মুখে জল ভরে আসে। কিন্তু যে বাঙালিদের স্বাদ পুষ্ট করেছে এখানকার জলহাওয়া? তাদেরও তো একটা সেকাল থাকে। সে কাল জুড়ে বসে নেবু-নুচির মতো শব্দ, ছাদে শুকোতে দেওয়া কাসুন্দি-আমসত্ত্ব আর কেয়া-খয়েরের পাহারা, ধনী বাবুদের পুতুলের বিয়েতে ভিয়েন বসার গল্প। যমদত্ত এপার-ওপার ঘুরে এসে এই সিদ্ধান্তে থিতু হন যে, পদ্মার ইলিশের তেল বেশি আর গঙ্গার ইলিশের গন্ধ। সে বাঙালির জমি-পুকুর না থাক, তারও পাতে ভরভরন্ত ভাত মাছ দুধ ছিল বইকি সেকালে। তাই সময়ে-অসময়ে অতিথির জন্যও তার দ্রৌপদীর থালা বেড়ে দেওয়া যেত। বাঙালির আরও পুরনো দিনে যেমন ভোজের বাহার ছিল, সেকেলে কলকাতার ধনী ঘরে যেন তার একচিলতে আভাস মিলবে। সেই যে মনসামঙ্গল বলে, চাঁদ সদাগরের ছোট ছেলের বিয়েতে এলাহি ভোজের আয়োজন। চিতল মাছের কোল ভাজা, জিরে লবঙ্গ মাখিয়ে ভাজা বড় বড় কই, লঙ্কা দিয়ে মাগুর মাছের ঝোল, আম দিয়ে কাতলা মাছ, মহাশোলের অম্বল, চিংড়ি মাছের রসোল্লাস, পাবদা মাছ ও আদা দিয়ে শুক্তুনি… প্রায় আঠেরো রকমের মাছের পদের পরেও তালিকা ফুরোয় না। আর উনিশ শতকের ঠাকুরবাড়িতে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী যখন খেজুরের পোলাও, ধূমপক্ব ইলিশ, পেঁয়াজের পরমান্ন, কাঁচা তেঁতুলের সরস্বতীঅম্বলের মতো অগুনতি পদে মেনুকার্ড সাজান, তখন মনে হয় বাঙালির ভোজনবিলাসে কালের নজর পড়েনি।
এপার বাংলায়, বিশেষ করে মোকাম কলকাতার বাসিন্দাদের কাছে অন্যরকম খাবারের স্বাদও এসে পৌঁছেছিল আরেকটু আগে। সত্যজিতের বকুলবাগানের ছেলেবেলার স্মৃতিতে যেমন থেকে যায় মেমসাহেবের হাতে বানানো কেক-প্যাটি নিয়ে ‘বাক্সওয়ালা’ কিংবা আউটরাম ঘাটে আইসক্রিম খাওয়া। ধর্মতলার সাহেবি অফিসপাড়া কেরানি বাবুদের জন্য বানিয়ে ফেলেছিল মশলাবিহীন স্টু, কিংবা ‘ফিশ অ্যান্ড চিপস’-এর বঙ্গীকরণে ফিশ ফ্রাই। ‘কভারেজ কাটলেট’ যেমন কেবিনের কপিরাইটওয়ালা ‘কবিরাজি’ হল, তেমনই খানিক ফিশ ফ্রাই গোত্রেরই খাবার চিনে ক্রেপ রোল, বড়ুয়ার হাত ধরে বাংলায় এসে নাম নিল ‘প্যান্থারাস’। সাহেবি থেকে চিনে, মোগলাই থেকে পার্সি, নানা দেশের নানা ঢঙের খাবারের স্বাদকে এক পাতে বেড়ে দিয়ে কলকাতা কবেই তো হয়ে উঠেছে এক সার্থক ‘মেল্টিং পট’। তার মান রেখে একালের বাঙালির প্লেটে মোমো থেকে পিজ্জা, ইডলি থেকে লিট্টির জবরদখল। কলকাত্তাইয়া প্রাতরাশের বনেদি কচুরিকে পাশে সরিয়ে, কিংবা মন্দিরের ধারে ধারে থাকা লুচির দোকানেও আজকাল জাঁকিয়ে বসছে পুরি কিংবা ছোলে বাটোরা।
আসলে কেবল কাঁটাতারের হিসেবে তো দেশ বদলায় না। দেশ বদলে যায় স্বাদ-গন্ধের বদলেও। স্বাদের শিকড় এমন করে বদলে যেতে থাকাও হয়তো একরকম বাস্তু হারানোর গন্তব্যে এগোয়। কিন্তু সত্যিই বাস্তু ছেড়ে যেতে হয়েছে যাদের? ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়া কেবল সেকালের বাঙালিরই ভাগ্যে লেখা হয়নি, আজকের বাঙালিও তো পাখির জীবন কাটায়। তার জিভে নানা শহরের স্বাদকাহন। কিন্তু তার মধ্যেও রসনাস্মৃতির এক বাসনাদেশ বুঝি জেগে থাকে কোথাও। মার্কিন-প্রবাসী বাঙালি তাই খুঁজেপেতে কিনে আনে কাসুন্দি বা বড়ির প্যাকেট, চিতল-বোয়ালের গরগরে ঝোলের কায়দায় রেঁধে ফেলে ক্যাটফিশ। পুরনো ঘর ছেড়ে একই দেশে কি একই শহরেও যারা বাসা বাঁধে, তারাও ছুটির শখে হাতড়ে নেয় মায়ের রান্নার রেসিপি। নিছক স্বাদবদলে, নাকি দেশ-ঘর কি মায়ের ঘ্রাণ পাওয়ার জন্য সেই তার জাদু সফর? তখনই বোঝা যায়, লটবহরের ওজনের হিসেব কিংবা পাসপোর্ট-ভিসার তোয়াক্কা না রেখে যে অবয়বহীন সঙ্গী তার হাত ধরে বাসা বদলেছে, সে আসলে তার স্বাদের উত্তরাধিকার। সে স্বাদ ভাগ হবে, কিন্তু তাতে ভাগাভাগির বেড়া উঠবে না কোনও দিনই।
:আরও শুনুন:
বাঙালির হাল-খাতা : ময়দানি তাঁবুতেও ফিরুক বাংলা
আরও শুনুন: বাঙালির হাল-খাতা : বছরের সঙ্গে সঙ্গে কি বদলে গেল প্রেমের মনও?
বাঙালির হাল-খাতা : সাহিত্য আর আড্ডার সুতোয় বাঁধা পয়লা বৈশাখ
বাঙালির হাল-খাতা : হালখাতার সঙ্গে বাঙালির বছর শুরুর পুজোপাঠ
বাঙালির হাল-খাতা : বাঙালির হাল-খাতা : বঙ্গনেতাদের কথায় ফিরুক সৌজন্য