বাংলা বছরের প্রথম দিন। শাস্ত্রে তেমন গুরুত্ব নেই। অথচ এই দিনেই দোকানে দোকানে পুজোপাঠ, হালখাতার আয়োজন। দক্ষিণেশ্বর-কালীঘাটে মানুষের ঢল। মাঠে-ময়দানে পুজো। আবার বাংলার লৌকিক জীবনেও ধর্মকে ধরেই উদযাপন নববর্ষের। পয়লা বৈশাখের পুজোর হাল-হকিকত খুঁজে দেখলেন শুভদীপ রায়।
অলংকরণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
ছবি: শুভ্ররূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভজিৎ মুখোপাধ্যায়
কথায় আছে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। আর বাঁধাধরা বারো পার্বণের মধ্যে না থাক, তেরো পার্বণ হিসেবে কিন্তু পয়লা বৈশাখ সগৌরবে হাজির! বাংলা বছরের শুরুটাই এমনভাবে হয়, যাকে কোনওভাবেই পার্বণের থেকে আলাদা করা যায় না। শহর থেকে গ্রামে ফিরলে পার্বণের বহর কিছুটা বদলায়। পুজোর ধরন কিংবা রীতিও আলাদা হতে পারে, কিন্তু উৎসবের আবহ তাতে কমে না এতটুকু।
শহরের পয়লা বৈশাখের কথা যদি ধরি, এই দিনে দক্ষিণেশ্বর-কালীঘাটে মানুষের ঢল নামে। বছরের পর বছর ধরে বাঙালি ব্যবসায়ীরা দলে দলে এই দিনে মন্দিরে ভিড় জমান। সঙ্গে থাকে লাল খেরোর খাতা, ছোট ছোট লক্ষ্মী গণেশের মূর্তি আর পুজোর সামগ্রী। মনে হতেই পারে, কালী মন্দিরে লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তি কেন?
সবটাই মনের বিশ্বাস আর চিরাচরিত ভক্তিতে ভর করে। বছর শুরুর আগে মায়ের আশীর্বাদ নিতেই মন্দিরে মন্দিরে ভিড় জমে। আর লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তি সারাবছর কাজের জায়গায় রেখে দেওয়ার জন্য। দোকান খোলার পর সেই মূর্তিতে ধূপ দেখিয়ে ব্যবসা শুরু হবে প্রতিদিন। যদিও পঞ্জিকা মতে পয়লা বৈশাখের বদলে অক্ষয় তৃতীয়াই হালখাতার জন্য প্রশস্ত, তবে দোকানেও পুজোর আয়োজন করে এদিন হালখাতা সারেন অনেকে। সব মিলিয়ে যতখানি ধর্মীয় উৎসব, তার চেয়ে অনেক বেশি করে মিলনোৎসব হয়ে ওঠে বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটি।
তাহলে পয়লা বৈশাখের সঙ্গে পুজো আচ্চার যোগ কোথায়? তার জন্য কয়েকটা দিন পিছোতে হবে। মূলত যে ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে পয়লা বৈশাখের যোগ টানা যায়, তা হল গাজন উৎসব। চৈত্রের শুরু থেকে একমাসভর সন্ন্যাস পালন করেন ভক্তরা। তারপর বছরের শেষদিনে গাজন, মূলত শিবের পুজো। টানা কয়েকদিন উপোস থেকে সন্ন্যাসীদের নগর ভ্রমণ, তারপর চড়ক-গাছে নিজেদের ঝুলিয়ে রাখা, পিঠে-নাকে-মুখে বঁড়শি বিঁধে ঘোরা- কৃচ্ছ্রসাধন আর নিজেকে কষ্ট দেওয়ার নানা পর্যায় পেরিয়ে নতুন বছরের সূচনা। লোকায়ত বাংলার এই উৎসব ধনী বাবুদের বদান্যতায় ঠাঁই করে নিয়েছিল শহরেও। উপরন্তু চৈত্র সংক্রান্তিতেই শহরের রাজপথে বেরোত সঙ। ঢাক, ঢোল, কাঁসি বাজিয়ে নানাধরনের ছড়া আর গান, হরেকরকম সাজে নিজেদের রঙিন করে তোলা, চলত সবকিছুই। রঙ্গে ভরা সমাজে সে যেন ছিল চোখে আঙুল দাদা।
বছরের শেষে নীলষষ্ঠী ব্রতও পালন করেন বাঙালি মায়েরা। সন্তানের মঙ্গল কামনায় রাখা এই ব্রতের পরে পরেই নতুন বছরের শুরু। চৈত্র সংক্রান্তির দিনেই হয় ভাইছাতু, ভাইয়ের মঙ্গল কামনা করে ভাইয়ের হাতের মুঠোয় ছাতু ভরে দেয় বোন। আবার পূর্বপুরুষকে স্মরণ করে ছাতু ভোগ দেওয়ার চলও আছে গ্রামবাংলায়। এই সময় আরও একটা পুজো চোখে পড়ে। বিভিন্ন পল্লিতে শনি-মঙ্গলবার করে আয়োজন করা হয় রক্ষাকালী পুজোর। বছরের শেষেই রোগভোগ থেকে রেহাই পাওয়ার আশায় শীতলা পুজোও হয়। আবার চৈত্রের শেষ কি বৈশাখের শুরুতেই আসে বাসন্তী পুজো, অন্নপূর্ণা পুজো কিংবা রামনবমী। শাস্ত্রীয় রীতিতে বাঁধা উৎসব ছাড়াও, বাঙালির লোকজীবনে যেভাবে ধর্ম মিশে আছে, তার ছাপ পড়ে পয়লা বৈশাখেও। যেমন তুলসী মঞ্চে ঝাড়া-বাঁধা। নীচে ছোট্ট একটা ছিদ্র থাকা ঘট, যা তুলসী মঞ্চের উপর বেঁধে দেওয়া হবে। সেখানে গোটা বৈশাখ মাস ভর জল দেওয়া হবে। সারাদিন ধরে ওই ছিদ্র দিয়ে জল পড়বে গাছে। একবারে যেন জল না শেষ হয়ে যায়, তার জন্য ওই পাত্রে দূর্বা ঘাস এবং কাঁচা আম ফেলে রাখা হয়। একইভাবে এমন ঝাড়া বাঁধা হয় বাড়ির শালগ্রাম শিলা কিংবা শিবলিঙ্গের উপর। কিছুই না, বৈশাখের তীব্র গরমেও যেন সারাদিন জল পায় তুলসী গাছ, এই কথা ভেবেই এমন ব্যবস্থা। আলাদা কোনও মন্ত্র নেই এই ঝাড়া বাঁধার। তবে ধর্মের আধারে এই প্রকৃতি-উপাসনার চল রয়ে গিয়েছে বাংলার জনজীবনে।
বছরের পয়লা দিনে পুজোর অবশ্য এখানেই শেষ নয়। এইদিনে বিশেষ এক পুজোর ব্যবস্থা হয় খেলার মাঠে। বলা ভালো ফুটবল ক্লাবে। পয়লা বৈশাখের দিনে বাংলার প্রায় সমস্ত ফুটবল ক্লাবেই বারপুজোর চল রয়েছে। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের মতো ক্লাবে এই বারপুজো উপলক্ষে এলাহি আয়োজন করা হয়।
ফুটবল মাঠের প্রান্তে থাকা গোলপোস্টে এই পুজোর ব্যবস্থা করা হয়। বলা ভালো, পুজো হয় ওই গোলপোস্টেরই। সেইসঙ্গে থাকে খাওয়াদাওয়ার এলাহি আয়োজন। ক্লাবের সমস্ত সদস্যদের নিমন্ত্রণ পাঠানো হয়। সমর্থকেরাও অংশ নেন পুজোয়। ময়দানের সঙ্গে যারা জড়িয়ে, পয়লা বৈশাখে এই বারপুজোর আলাদা গুরুত্ব রয়েছে তাঁদের কাছে। এছাড়া সমর্থকরাও এদিন ভিড় জমান মাঠে।
সুতরাং বাংলা বছরের পয়লা দিনে শাস্ত্রের হিসাবে কোনও পুজোর নিয়ম না থাকলেও, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাঙালির আবেগ। আর ধর্মেরও তো মূল কথা ধারণ করা। জাতির নিজস্ব চর্চা, তার সংস্কৃতিকে ধারণ করে থাকা। সেই ধর্মবোধের আবহেই পুজোর আনন্দও মিলেমিশে এক হয়ে যায় বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের সঙ্গে।
:আরও শুনুন:
বাঙালির হাল-খাতা : ময়দানি তাঁবুতেও ফিরুক বাংলা
বাঙালির হাল-খাতা : বছরের সঙ্গে সঙ্গে কি বদলে গেল প্রেমের মনও?
বাঙালির হাল-খাতা : সাহিত্য আর আড্ডার সুতোয় বাঁধা পয়লা বৈশাখ
বাঙালির হাল-খাতা : বাঙালির হাল-খাতা : বঙ্গনেতাদের কথায় ফিরুক সৌজন্য
বাঙালির হাল-খাতা: স্মৃতির ভাঁড়ার হাতড়েই পাত বাড়ে বাঙালি