দেশের লোক কলম চালায়, রসনাও চালায়, কিন্তু জাহাজ চালায় না- এই ক্ষোভ ছিল রবীন্দ্রনাথের নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ব্যবসার পথে বাঙালিকে স্বাবলম্বী হওয়ার পাঠ দিতে চেয়েছিলেন তিনি। খুলেছিলেন কখনও দেশলাইয়ের কারখানা, কখনও আবার তাঁতকল। এমনকি জাহাজের ব্যবসা পর্যন্ত শুরু করেছিলেন তিনি। কী হল সেই স্বদেশী ব্যবসার? লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।
জাহাজের খোল বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখে ঠাকুরবাড়ির ছেলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বেশ উৎসাহিত বোধ করলেন৷ দ্বারকানাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর তাঁর পরের প্রজন্ম তেমন উৎসাহ নিয়ে ব্যবসা করতে আসেননি ৷ বরং সেদিক দিয়ে দেবেন্দ্রনাথের পঞ্চম পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিভিন্ন ব্যবসার প্রতি আগ্রহ দেখা যায়৷ দেশের লোক কলম চালায়, রসনা চালায়, কিন্তু জাহাজ চালায় না- এমনটা দেখে রবীন্দ্রনাথের জ্যোতিদাদা বরং কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন৷ একদিন দুপুরে বেরিয়ে গিয়ে সাত হাজার টাকা দিয়ে নিলামে জাহাজের খোল কিনে আনেন জ্যোতিদাদা।
আরও শুনুন:
হিন্দু ধর্মকে আঘাতের অভিযোগ! কী উত্তর দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়?
এদিকে আবার ওই সময় কলকাতা থেকে খুলনা পর্যন্ত রেললাইন পাতা শুরু হওয়ায় খুলনা থেকে বরিশাল পর্যন্ত জলপথে পরিবহণের প্রয়োজনবোধ করেছিলেন অনেকেই। ফলে ওই জলপথে জাহাজ চালানো যেতে পারে বলে মনে হয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের। তিনি খোঁজখবর নিয়ে দেখেন এই পথে জাহাজ চালালে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এর আগে অবশ্য তিনি আরও বেশ কিছু ব্যবসায় নেমেছিলেন৷ স্বদেশি পণ্য উৎপাদন জরুরি মনে করে দেশলাই কারখানা গড়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বারবার ঘর্ষণের পরেও সেই কাঠি জ্বলেনি৷ আবার একইরকম উৎসাহে তাঁতকল বসিয়েছিলেন তিনি। যদিও সেই তাঁতকল একটি মাত্র গামছা প্রসব করে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ তবে ব্যবসা করতে গিয়ে নানারকম বাধার মুখে পড়লেও তাঁর সব ব্যবসার একইরকম অবস্থা হয়েছিল, তা ঠিক নয়৷ ভগ্নীপতি জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হাটখোলায় পাটের আড়ত খুলেছিলেন৷ তখন প্রতিদিন দুইজনে হাটখোলায় গিয়ে আপিস করতেন। ভালোই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ পাটের ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়ায় সেই ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হয়৷ কিন্তু ওই কিছুদিনের ব্যবসা থেকেও বেশ মুনাফা হয়েছিল ৷ আর সেই লাভের টাকা তিনি শিলাইদহে নীল চাষের জন্য বিনিয়োগ করেছিলেন৷ এই কাজ ভালোই চলছিল৷ কিন্তু বছর চার-পাঁচেকের মধ্যেই নীল চাষে এতই উন্নতি ঘটে গেল যে, নীলের উৎপাদন বেড়ে গেল, ফলে এর বাজার ধাক্কা খেল৷ অন্যদিকে আবার ওই সময় জার্মানরা কৃত্রিম নীল উৎপাদন শুরু করায় আসল নীলের বাজারে ধস নামে৷ পরিস্থিতি বিবেচনা করে নীল চাষ থেকে সরে আসেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ৷ তাও নীল থেকে তিনি বেশ কিছুটা লাভবান হয়েছিলেন৷
নিলামে জাহাজে খোল কিনে ভেবেছিলেন বেশ সস্তায় বস্তুটি পাওয়া গেল। কিন্তু সেই বস্তুটিকে মেরামত করাতে গিয়ে বুঝলেন ঠিক যেমনটি ভেবেছিলেন তেমনটি নয়৷ মেরামত করতে লক্ষাধিক টাকা খরচ হল৷ সেই খোলে যে জাহাজ তৈরি হল তার নাম রাখা হল ‘সরোজিনী’। ঠিক তখনই তাঁর জীবনে এক বিপর্যয় ঘটে যায়। হঠাৎ স্ত্রী কাদম্বরীর অস্বাভাবিক মৃত্যু । স্বাভাবিকভাবেই কিছুদিনের জন্য এই কাজে ছেদ পড়ল। তাও শোক কাটিয়ে অল্পদিন পরে তিনি ফের জাহাজ ফেরি চলাচলের বিষয়ে নজর দিলেন। তবে এই ক্ষেত্রে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে ফাঁকা মাঠ পাবেন ভাবছিলেন তা আর হল না। বিদেশ থেকে ফ্লোটিলা নামে এক জাহাজ কোম্পানি এসে গিয়েছে এই পথে পরিষেবা দিতে। বুঝলেন ওই বিদেশি কোম্পানির জাহাজে যাত্রীরা ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়লে মুশকিল হবে আগামী দিনে ঠাকুরবাড়ির জাহাজ চালনায়। তা ছাড়া সরোজিনী জাহাজটি প্রস্তুত হয়ে পড়ে রয়েছে, সেখানে বসে বসে সময় ব্যয় করা উচিত নয়।পাশাপাশি অনুভব করলেন বিদেশি ফ্লোটিলার সঙ্গে টক্কর দিতে হলে আরও বড় করে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে যাতে বিদেশি প্রতিযোগী সংস্থাটিকে হটিয়ে দেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে একটা জাহাজই যথেষ্ট নয়। ফলে কেনা হল চারখানা জাহাজ -‘বঙ্গলক্ষ্মী’, ‘স্বদেশি’, ‘ভারত’ এবং ‘লর্ড রিপন’৷ তাঁর সর্বস্বই ঢেলে ফেললেন এই জাহাজগুলি কিনতে।
এই ফেরি পরিষেবা ঘিরে বরিশালের স্থানীয় মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে মোহিত হলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ৷। যেদিন সরোজিনী খুলনা থেকে বরিশালের ঘাটে প্রথম পৌঁছল তা দেখতে ভিড় উপচে পড়েছিল ঘাটে৷ আগেই বিদেশি কোম্পানির ফ্লোটিলা চলাচল শুরু করেছিল। কিন্তু ঠাকুরদের সরোজিনী হল স্বদেশি জাহাজ, বাংলার জাহাজ, বাঙালি জাহাজ। প্রথম দিন থেকেই একদল ছাত্র যুবার মধ্যে অদ্ভুতরকম সক্রিয়তা দেখা গিয়েছিল যাত্রীদের ফ্লোটিলার বদলে সরোজিনীতে টেনে আনার জন্য ৷ ওইসব ছেলে ছোকরার দল যাত্রীদের কাছে করজোড়ে আবেদন জানাতে থাকে- ‘‘কেন দেশের টাকা বিদেশিদের দেবেন , যে সাহেবরা এত অপমান করে। তার চেয়ে বরং ঠাকুরবাবুরা যে জাহাজের বন্দোবস্ত করেছে সেটা চড়ুন।’’ প্রশ্ন তোলে- বাঙালি হয়ে বাঙালি ঠাকুরবাবুর জাহাজ থাকতে কেন তাঁরা বিদেশি জাহাজে চড়ছেন! যাত্রী টানতে নানাভাবে প্রচার করতে থাকে ওই ছেলে ছোকরার দল ৷ এদের পীড়াপীড়িতে ফ্লোটিলার প্রায় অর্ধেক যাত্রী চলে আসে সরোজিনীতে। সেই যাত্রী নিয়ে সরোজিনী ফিরে চলে খুলনার দিকে। অর্থাৎ সেদিন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ফ্লোটিলা কিছুটা ‘অ্যাডভান্টেজ পজিশনে’ থাকাসত্ত্বেও প্রথম দিন হিসেবে ওভাবে যাত্রীদের সরোজিনীতে টেনে আনাটা অবশ্যই ছিল ঠাকুরদের কাছে বড় সাফল্য।
এর পর রোজই যাত্রী সংখ্যা কিছুটা করে বাড়তে থাকে ঠাকুরদের জাহাজে। শুধু তাই নয়, ঠাকুরদের আরও দু’টি জাহাজ স্বদেশি এবং বঙ্গলক্ষ্মী এসে পৌঁছয় । এদিকে জাহাজ পরিষেবার ক্ষেত্রে বাঙালিবাবুর বাণিজ্য বিস্তার সাহেবরা ভালো চোখে দেখল না৷ সাহেব কোম্পানি চায় না এই পরিষেবার ক্ষেত্রে কোনওরকম প্রতিযোগিতা থাকুক৷ তারা চায় এখানে একচেটিয়া বাজার দখল করে রাখতে৷ ফলে উকিল মারফত জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছে ফ্লোটিলার মালিকপক্ষ বার্তা পাঠাল- তারা ঠাকুরদের জাহাজ এবং তার আনুষঙ্গিক অন্যান্য সম্পত্তি কিনে নিতে চায় বলে৷ কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ব্যবসা করবেন বলেই এতগুলো জাহাজ কিনেছেন। সুতরাং যতদিন পারবেন ততদিন এই ব্যবসা চালাতে চান । ব্যবসা বাড়লে অন্য পথে জাহাজ চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর৷ ফলে সাহেবদের সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন তিনি ৷
বিশেষত তখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মনে হল, এখানকার মানুষের আবেগকেও মর্যাদা দিতে হবে, কারণ তাদের জন্যই জাহাজগুলি চলছে এবং যাত্রীসংখ্যা বাড়ছে।ফ্লোটিলা অনেক বড় কোম্পানি বিদেশে বহু জায়গায় ওদের স্টিমার চলে৷ ফলে কোনও এক জায়গার বাজার ধরতে বেশ কিছুদিন ধরে সেখানে ক্ষতির বোঝা টানার ক্ষমতা রাখে এই কোম্পানি। সেই কৌশল প্রয়োগ করল ফ্লোটিলা- যাত্রী ভাড়া কমিয়ে দিল। স্বদেশি সেন্টিমেন্ট ধাক্কা খেল যাত্রীদের মধ্যে৷ আর্থিক সুরাহা হবে বলে ধীরে ধীরে বিদেশি জাহাজে যাত্রী বাড়তে লাগল ৷ পালটা কৌশল হিসেবে ঠাকুরদের জাহাজে আরও কিছুটা ভাড়া কমানো হল ৷ এই কৌশল ম্যাজিকের মতো কাজ দিল- জাহাজের যাত্রীদের ছবিটা ফের বদলে গেল। ঠাকুরদের দেশীয় জাহাজ যাত্রীতে বোঝাই আর সাহেবদের জাহাজ ফাঁকা। অর্থাৎ বাজার দখলের জন্য দেশি বিদেশি দুই সংস্থার মধ্যে নৌ-যুদ্ধ শুরু হল৷ শুধু ভাড়া কমানো নয়, যাত্রী আকর্ষণের জন্য নানা পন্থা নেওয়া হল। ভাড়া কমানোর পাশাপাশি এবার ফল, মিষ্টি, গামছা, শাড়ি ধুতি নিয়ে উপহারের ডালি সাজিয়ে যাত্রীদের কাছে হাজির স্বদেশি বিদেশি দুই জাহাজ কর্তৃপক্ষই। যেন মনে হতে লাগল যাত্রীরা জাহাজে উঠে জাহাজের মালিককে কৃতার্থ করছে। খুলনা-বরিশালের মানুষেরা এমন দিন আসবে কল্পনাও করতে পারেনি। উপহারের লোভে প্রয়োজন না থাকলেও কেউ কেউ জাহাজে চড়ে বসলেন। তখন আবার যাত্রীদের ভিড় সামলাতে রক্ষী নিয়োগ করতে হল। সেই মুহূর্তে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছে জাহাজের ব্যবসা চালানোটা যেন একপ্রকার নেশায় পরিণত হয়েছে । কারণ তাঁর তখন একটাই স্বপ্ন, ঠাকুরবাড়ির স্বদেশি জাহাজকে সাহেবদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জিততেই হবে।
আরও শুনুন:
রবীন্দ্রনাথ যদি ভোটে দাঁড়াতেন, কী থাকত নির্বাচনী ইস্তাহারে?
মানুষের জীবনে দুর্ঘটনা বলে কয়ে আসে না। কিন্তু দুর্ঘটনাই সব কিছু ওলটপালট করে দিতে পারে। এই সময় মাল বোঝাই করা স্বদেশি জাহাজটি খুলনা থেকে কলকাতা আসতে গিয়ে হাওড়ার কাছে কিছুতে ধাক্কা খেয়ে ডুবে গেল। ওই জাহাজডুবির পিছনে সাহেব কোম্পানির কোনও হাত ছিল কি না জানা যায়নি। তবে যারা একচেটিয়া বাজার দখল করতে চায়, তারা যতই সুস্থ প্রতিযোগিতার কথা বলুক না কেন, প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরাতে বহু ক্ষেত্রেই অন্তর্ঘাতের আশ্রয় নিয়েই থাকে। এক্ষেত্রে ফ্লোটিলার পক্ষে তাদের পথের কাঁটা এই দেশীয় কোম্পানিটিকে হঠাতে তেমন কিছু করাটা অস্বাভাবিক নয়।
সেদিন ওই জাহাজ শুধু ডুবল না, ডুবিয়ে দিল ঠাকুরবাড়ির জাহাজের কোম্পানিটিকেও। ডুবে যাওয়া জাহাজে যাত্রী না থাকলেও তাতে থাকা পণ্যের জন্য বিরাট ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ঘাড়ে৷ এমনিতেই তিনি যেভাবে জাহাজ চালাচ্ছিলেন তাতেই বহু অর্থ খরচ হচ্ছিল।যার জন্য বন্ধুবান্ধব পরিচিতদের কাছে থেকে ধার নিয়ে ঋণে নিমজ্জিত হয়েছিলেন। তার উপর এই দুর্ঘটনা তাঁকে নিরুদ্যম এবং হতাশ করে তুলল৷ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের এই বিপন্ন অবস্থায় ফ্লোটিলার কাছ থেকে প্রস্তাব এল– এভাবে প্রতিযোগিতার নামে উভয়ের অর্থ ব্যয় করে লাভ কী? বরং যা মূল্য চাওয়া হবে সেই মূল্যেই ফ্লোটিলা ঠাকুরদের এই জাহাজের ব্যবসা কিনে নিতে প্রস্তুত৷ এবার আর সে প্রস্তাব ফেরানোর মতো অবস্থায় নেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।আর্থিক কারণে সম্মতি দিতে বাধ্য হলেন তিনি।
ফ্লোটিলার কাছ থেকে যা পাওয়া গেল তা নায্য পাওনার কিছু বেশি হলেও তা যথেষ্ট নয় ঋণের দায় মেটানোর জন্য৷ ওই অর্থ দিয়ে অনেকটা ঋণ পরিশোধ হলেও পুরোটা হল না৷ দাদা সত্যেন্দ্রনাথের সহপাঠী তারকনাথ পালিত জ্যোতিকে খুব স্নেহ করতেন। বিপদে অভিভাবকের মতো জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পাশে এসে দাঁড়ালেন তিনি। ডেকে পাঠালেন সমস্ত পাওনাদারদের।পাওনা কতটা বাকি তার হিসেব-নিকেশ চলল।তারকনাথ নিজে দায়িত্ব নিয়ে এমন ব্যবস্থা করলেন, যার ফলে ঋণমুক্ত হলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ৷
তথ্যঋণ:
১) রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২)জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি- বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়
৩)প্রথম আলো- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (প্রথম পর্ব)
৪) বাঙালির বাণিজ্য -হরপ্পা (পঞ্চম বর্ষ প্রথম সংখ্যা)