শিক্ষার আলো ছড়িয়েই জগৎসভায় দেশকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন প্রশান্তচন্দ্র, আজ যাঁকে ‘ভারতীয় রাশিবিজ্ঞানের জনক’ বলা হয়। আর সে কাজে পাশে পেয়েছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথকেও। স্ট্যাটিসটিক্সের পারিভাষিক শব্দ যে রাশিবিদ্যা বা রাশিবিজ্ঞান, তা রবীন্দ্রনাথেরই সৃষ্টি। সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে রাশিবিদ্যা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে চান, প্রশান্তচন্দ্রের এই ভাবনাকে যিনি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন, তিনি রবীন্দ্রনাথই। এদিকে, তাঁকে হিংসাই করেন মনে মনে, এ কথা বলতে পর্যন্ত দ্বিধা করেননি সেই রবীন্দ্রনাথই।
সম্প্রতি দেখা গেল, এক কৃতী ছাত্র আইএসআই-এ পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করায় অনেকেই ধরে নিলেন, তা আসলে পাক গুপ্তচর সংস্থা। অর্থাৎ আইএসআই কী, তা-ই জানা নেই অনেকের। কিন্তু এহেন অপরিচয়ের উদাসীনতা তো প্রাপ্য ছিল না প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের। পরাধীন ভারতেই যিনি আইএসআই তথা ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অনেকদিক থেকেই পিছিয়ে থাকা দেশ, যে তখনও বিদেশি শক্তির অধীন, সেখানে একেবারে আধুনিক যুক্তিবাদী একটি বিষয়ের আমদানি করেছিলেন তিনি। শিক্ষার আলো ছড়িয়েই জগৎসভায় দেশকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তিনি, আজ যাঁকে ‘ভারতীয় রাশিবিজ্ঞানের জনক’ বলা হয়। আর সে কাজে পাশে পেয়েছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথকেও। স্ট্যাটিসটিক্সের পারিভাষিক শব্দ যে রাশিবিদ্যা বা রাশিবিজ্ঞান, তা রবীন্দ্রনাথেরই সৃষ্টি। সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে রাশিবিদ্যা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে চান, প্রশান্তচন্দ্রের এই ভাবনাকে যিনি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন, তিনি রবীন্দ্রনাথই। এদিকে, তাঁকে হিংসেই করেন মনে মনে, এ কথা বলতে পর্যন্ত দ্বিধা করেননি সেই রবীন্দ্রনাথই।
-: আরও শুনুন :-
ভোটপ্রচারে নিন্দেমন্দের শেষ নেই! সভায় কথা বলবেন কোন রীতিতে, শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ
সত্যি বলতে, কবিগুরুর জীবনের অনেকটা সময় জুড়েই তাঁর সঙ্গী ছিলেন প্রশান্তচন্দ্র। শান্তিনিকেতনে গিয়ে সারারাত জেগে রবীন্দ্রনাথের ‘লিপিকা’ নকল করে নিচ্ছেন তিনি, অসুস্থ প্রেমিকাকে শোনাবেন বলে। আবার সেই প্রেমিকাকেই যখন অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বিয়ে করছেন, সে অনুষ্ঠানে কনের পরিবারের কেউ নেই, অথচ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সেরে রাত্রিবেলায় হাজির হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। উপহার দিচ্ছেন সেই ‘লিপিকা’-র পাণ্ডুলিপিই। আবার কবির সমস্ত লেখা পত্র-পত্রিকা থেকে খুঁজে বার করার কাজও করেছেন এই বিজ্ঞানের ছাত্রটিই। কবির নামহীন একাধিক গল্প-প্রবন্ধ খুঁজে আনার কৃতিত্বও তাঁরই। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছিল আরও আগে, যখন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে একা সুর চড়িয়েছিলেন তিনি। সালটা ১৯২০। রবীন্দ্রনাথকে কিছুতেই সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সম্মানিত সভ্য করা যাবে না, এই নিয়ে নবীন-প্রবীণের বিতর্কে তুলকালাম। গণভোট অব্দি গড়িয়েছে এর মীমাংসা। প্রায় ২৫০-এর উপর ভোট পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের বিপক্ষে। এমন সময়ে, ১৯২১ সালের ১৫ই মার্চ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হিসাবে প্রশান্তচন্দ্র লিখলেন, ‘কেন রবীন্দ্রনাথকে চাই’। রবীন্দ্রনাথকে প্রত্যাখ্যান করার পিছনে যত যুক্তি ছিল, প্রশ্ন ছিল, সে সবকিছুর জবাব তিনি দিয়েছিলেন যুক্তি আর তথ্য দিয়েই। শেষে বলেছিলেন, “তথাপি বলিব না যে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কোনো দোষ ত্রুটি নাই। …কিন্তু তাঁহার সমস্ত দোষ ত্রুটি অপেক্ষা তিনি বড় বলিয়াই তাঁহাকে চাই।” কোনও মানুষ বড় বলেই যে তিনি সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে, তাঁর মতের সামনে ভিন্নমত রাখা যাবে না, এ ধারণা ভেঙেছিলেন প্রশান্তচন্দ্র। একইসঙ্গে তেমন মানুষের ত্রুটি যে তাঁর সব গুণকে ঢেকে দিতে পারে না, সে কথাও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
পারস্পরিক যোগাযোগ যেখানে এমন শ্রদ্ধার, সেখানে হিংসার প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে! সে কথা নিজেই জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রশান্তচন্দ্রের স্ত্রী রাণী মহলানবিশ লিখছেন, “কবি দিনের বেলায় আমার স্বামীকে খানিকক্ষণ না দেখতে পেলেই ঠাট্টা করে বলতেন, “ঐরে আবার অঙ্ক কষতে বসেছে। আজ আর তাহ’লে তোমার কোথাও বেরোন হবে না।” তারপরই হেসে বলতেন, “জানো, ঐ জায়গায় ও আমাকে বেজায় হারিয়ে দিয়েছে। দিনরাত খাতার উপর ঝুঁকে প’ড়ে ও যখন অঙ্ক কষে, দেখে ভারি হিংসে হয়, আর নিজের ’পরে রাগ ধরে ছেলেবেলায় ইস্কুল পালিয়েছিলাম বলে। তা না হলে দেখতে আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী কাণ্ড করত।” এখানেই থামছেন না কবি, আরও বলছেন, “প্রশান্তর মোটা মোটা অঙ্কের বইগুলো যখন দেখি তখন ভাবি ঐ একটি রাজ্যে শুধু আমার প্রবেশ করা হোল না। …অনেক সময় ভাবি এখনও আরম্ভ করলে যদি হত তো একবার চেষ্টা করে দেখতুম; কিন্তু আর হয় না– বড্ড দেরি হয়ে গেছে; কাজেই বাধ্য হয়ে ওর কাছে মাথা হেঁট করে থাকি।” বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও প্রশান্তচন্দ্র তাঁর লেখা পড়ে উপভোগ করতে পারেন, কিন্তু প্রশান্তচন্দ্রের নিরন্তর চর্চা তিনি বুঝতে পারছেন না, স্নেহের জোরেই এখানে হার মেনে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
-: আরও শুনুন :-
কেবল হিন্দুত্বের কথাই কি বলে বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদ?
সাহিত্য আর বিজ্ঞানের দুই শাখার মাঝে সচরাচর দেওয়াল তুলেই রাখি আমরা। সেখানে দুই জগতের এই দুজন মানুষের অনায়াস সম্পর্ক এক চলাচলের পাঠও দিয়ে যায়। কাজের জগতের যাবতীয় কৃতিত্ব ছাড়াও, পরস্পরকে শ্রদ্ধা করার এই শিক্ষাকেও মনে করিয়ে দিতে পারেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ।