তিনি লিখেছিলেন, ‘মেয়ে কি ম্যাজিক জানে?’ অন্য কারও কথা থাক, তিনি বোধহয় সত্যিই ম্যাজিক জানতেন। জানতেন দুঃখকে তুড়ি মেরে এগিয়ে যাওয়ার ম্যাজিক। কোত্থাও আপস না করে মাথা উঁচু করে চলার মন্ত্রও জানা ছিল তাঁর। তিনি নবনীতা দেবসেন। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তাঁর কথা।
ছোটবেলায় মা-বাবার হাত ধরে গিয়েছিলেন উত্তরায়ণে। নিমন্ত্রণ করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এদিকে পাতে খাবার পড়তেই সাদা ভাত দেখে ছোট্ট মেয়েটির সটান মন্তব্য, এ আবার কেমন নেমন্তন্ন? পোলাও নেই? মা রাধারাণী দেবী চূড়ান্ত বিব্রত। বাবা নরেন্দ্র দেব হেসে উঠেছেন। আর খোদ নিমন্ত্রণকর্তা যেন একান্ত লজ্জিত। পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে রীতিমতো ধমক দিয়ে বললেন, সত্যিই তো, পোলাও না থাকলে কি নিমন্ত্রণ হয়? এক্ষুনি রান্না করে দাও পোলাও। তারপর কানে কানে রেসিপি বাতলে দিলেন নিজেই।
আরও শুনুন: প্রথম বাঙালি মহিলা হিসেবে লিখেছিলেন আত্মজীবনী, জানেন কে তিনি?
কী ছিল সেই রেসিপিতে? বড় হয়ে উঠে মেয়েটি নিজের লেখায় জানিয়েছিলেন, সুগন্ধি চালে ঘি, এলাচ, লবঙ্গ, তেজপাতা, কিশমিশ, আর কমলালেবুর খোসা ছাড়ানো একমুঠো কোয়া দিয়ে নেড়েচেড়ে নেওয়া সেই পোলাও সেদিন সোনামুখ করে খেয়েছিলেন তিনি। তিনি আর কেউ নন, নবনীতা দেবসেন।
আরও শুনুন: বন্দুক হাতে জমিদারি সামলাতেন ঠাকুরবাড়ির এক মেয়ে, চেনেন তাঁকে?
এত বড় মানুষ হয়েও ছোটবেলার সেই সরলতা আর স্পষ্টবাদিতাকে আজীবন যত্নে লালন করেছিলেন নবনীতা। রাস্তায় আলাপ হওয়া কেউ মাছ ভাত খাওয়ার নিমন্ত্রণ করলে দুই মেয়েকে নিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে যেতে তাঁর বাধেনি। বাধেনি হায়দ্রাবাদ ইউনিভার্সিটির গুরুগম্ভীর সেমিনার সেরে এক কাপড়ে কুম্ভমেলা দেখতে যেতে। আবার ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার কয়েক বছর পরে লেখা ‘বামাবোধিনী’ উপন্যাসে দেশের প্রান্তিক রামকথার উচ্চারণগুলি তুলে আনতেও তিনি ভয় পাননি। রামায়ণের এই ভিন্ন পাঠ, অঞ্চলভেদে, লেখকভেদে তার স্বরের বদল, বিশেষত রামকথার প্রতি মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নবনীতার গবেষণার বিষয়। তিনি বলেছেন কিশোরগঞ্জের ব্রাহ্মণকন্যা চন্দ্রাবতীর ষোড়শ শতকে লেখা বাংলা রামায়ণের কথা, যেখানে সীতাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বারবার রামের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন লেখিকা। অন্ধ্রপ্রদেশের গ্রাম গোপভরমের কুমোর কন্যা মোল্লার কথাও বলতে ভোলেননি নবনীতা। যিনি নিজের ভাষা তেলুগুতে রামায়ণ রচনা করেছিলেন। ছাঁচে ঢালা রামসীতার কথা লিখলেও শূদ্র মেয়ের লেখা মহাকাব্যকে নাকচ করেছিল পণ্ডিত সমাজ। আসলে নবনীতা জানতেন মেয়েদের স্বর কীভাবে চাপা পড়ে যায়। তিনি জানতেন তাঁর মা রাধারাণী দেবীকে কেন ‘অপরাজিতা’ ছদ্মনামের আড়ালে কবিতা লিখতে হয়। হয়তো সেই কারণেই তাঁর সীতা গবেষণার পুথি ছেড়ে জীবন্ত হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক রামতন্ত্রের মুখোমুখি হওয়ার আগে যে সামাজিক রামতন্ত্রকেও চিহ্নিত করা জরুরি, সে কথা বুঝতে ভুল হয়নি তাঁর। সেই পিতৃতন্ত্র যে সংস্কারের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকে, এমনকি মেয়েরাও তার অংশ হয়ে যায়, তা বুঝিয়েও দিয়েছেন তিনি। ‘সীতা থেকে শুরু’ বইয়ে সীতার কথা, সীতার মতো মেয়েদের কথা বলতে বলতে তাই মা আর দুই মেয়েকে নিয়ে গড়ে ওঠা নিজের পরিবারে পৌঁছে যান নবনীতা। সেখানেও তো ছেড়ে যাওয়ার আখ্যান রয়েছে। রয়েছে একলা মায়ের সন্তান বড় করে তোলার কাহিনিও। আর রয়েছে সেই যাত্রা কীভাবে শক্তি জোগায়, তার কথাও। কিন্তু এই সীতা নির্মাণে যান্ত্রিকতার আভাস মাত্র রাখেননি নবনীতা। সেখানে মিলেমিশে গিয়েছে পারা না-পারা, সাফল্য ব্যর্থতা, হাসি কান্না, সব কিছুই। বিশাল এই দেশের প্রান্তে প্রান্তে যে এত সীতার পাঁচালি গেয়ে চলে মেয়েরা, নবনীতা বুঝেছিলেন, তার ভেতরে রয়েছে নিজের মতোই আরও একটি মেয়ের সঙ্গে সই পাতানোর প্রস্তাবনা। এই বেঁধে থাকার প্রয়োজনীয়তা বুঝেছিলেন বলেই ‘সই’ নামের প্রতিষ্ঠানটির সূচনা। ‘সই’ শব্দের তিনটি অর্থ, সখী, স্বাক্ষর আর সহ্য করা, মেনে নিয়েও দৃঢ় ঘোষণা করেছিলেন, “শুধু সহ্য করাটার সঙ্গে সই পাতাব না।” তাঁর গবেষণার শেষতম আখ্যান সম্ভবত হয়ে উঠেছে তাঁর এই স্বরচিত সীতাকাহিনি-ই, আধুনিক কালের এক মেয়ের বারোমাস্যা। চর্চা আর চর্যাকে এক বিন্দুতে মিলিয়ে নিয়ে স্বতন্ত্র এক ভাষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছেন নবনীতা দেবসেন।