চন্দ্রাবতী রামায়ণকে সাহিত্যের ইতিহাসকারেরা মান্যতা দিতে চাননি। বিস্মৃতির আড়াল থেকে তা তুলে এনেছিলেন নবনীতা দেবসেন। রামভক্তদের এই দেশে সীতার কথা, সীতাদের কথা যে কৌশলে চাপা দেওয়া হয়, তা তিনি টের পেয়েছিলেন। নবনীতা মনে করেছিলেন, যে রামকথা নিষ্করুণ, যা নির্মমতার পক্ষে লাগাতার সওয়াল করছে, সেই রামকথার বিরুদ্ধে লড়তে গেলে ওই মায়াঘেরা অন্য রামায়ণই হয়ে উঠতে পারে একরকম আয়ুধ।
লিখছেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
যাকে চলতি কথায় নারীবাদ বলে চিনি, নিজেকে কেবল সেই তকমায় বেঁধে রাখতে আপত্তি ছিল নবনীতা দেবসেনের। কিন্তু মেয়েদের অধিকারের পক্ষে যে নারীর নিজস্ব স্বরকেই গর্জে উঠতে হবে, আবার মেয়েদের আঘাতেও শুশ্রূষা বুলিয়ে দেবে সেই নারী-স্বর, এ কথায় বিশ্বাস ছিল তাঁর। তাই নিজের জীবন আর যাপনে সেই স্বরের খোঁজ তিনি জারি রেখেছিলেন বরাবর।
তাঁর লেখা আর পড়ার ভুবনটিও সেই খোঁজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই, একদিকে যেমন ভারতের রামকেন্দ্রিক কঠোর রাজনীতির অসংগতি নিয়ে তিনি সরব হয়েছেন, তেমনই দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে অন্য রামকথাগুলি খুঁজে ফিরেছিলেন নবনীতা। কারণ তিনি দেখেছিলেন, দেশের মেয়েরা যেভাবে রামায়ণকে দেখছে, তা প্রচলিত রামায়ণের পুরুষালি বীরত্বের স্বর থেকে বদলে বদলে যাচ্ছে অনেক সময়ই। মেয়েদের দেখা অনেকসময়ই আত্মস্থ করে নিচ্ছে সীতার ভঙ্গিকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন মেয়ের মুখে এই যে একই সুরে গীত হচ্ছে রামায়ণ- এর যোগসূত্রটি কী? ভিতরে ভিতরে কোন শিরা ধমনি দিয়ে বয়ে চলেছে সেই একই স্রোতের ধারা? অন্য ধরনের রামায়ণ নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি সেই সূত্রটিকেও চিনতে চেয়েছিলেন নবনীতা দেবসেন।
রামায়ণ তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল তাঁর মানবীবিদ্যা চর্চার এক বড় হাতিয়ার।
-: আরও শুনুন :-
‘মেয়েলি লেখিকা’ তকমা নিয়েই আশাপূর্ণা তুলে ধরেছিলেন রুদ্ধস্বরের কথকতা
নবনীতা এই কাজ শুরু করেছিলেন চন্দ্রাবতী রামায়ণ নিয়ে। বাংলায় যখন রামায়ণের অনুবাদ শুরু হয়ে গিয়েছে, রাজা-বাদশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় নরকুলচন্দ্র রামের শৌর্য-বীর্যের কাহিনি শোনাচ্ছেন পুরুষ কবিরাই, সেখানে চন্দ্রাবতী রামায়ণে সখীদের সঙ্গে বসে সহজ ভঙ্গিতে সীতা বলে চলেছেন তাঁর রামের সঙ্গে বিয়ে আর দাম্পত্যের কথা। বলছেন বনবাসের কথা, অপহরণের কথা, লঙ্কায় তাঁর বন্দি দিনগুলির কাহিনি। সেখানে রামের বীরত্বের কথা প্রায় নেই, রামের যাবতীয় মহাকাব্যিক কীর্তিকলাপও এখানে প্রায় গরহাজির; কেন-না সীতার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তো সেসব কথা নেই। তিনি বলতে বসেছেন নিজের বারোমাস্যার কথা। রামায়ণের এমনই এক পালটা বয়ান লিখেছিলেন এক বাঙালি নারী, চন্দ্রাবতী।
ষোলো শতকের গ্রামীণ পূর্ববঙ্গে সেই নারী প্রেমিকের বিশ্বাসঘাতকতার কথা জেনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, স্বেচ্ছায় অবিবাহিত থাকবেন তিনি। লিখবেন রামকথা। সেই চন্দ্রাবতী রামায়ণকে সাহিত্যের ইতিহাসকারেরা মান্যতা দিতে চাননি। কিন্তু তাকেই বিস্মৃতির আড়াল থেকে তুলে এনেছিলেন নবনীতা দেবসেন।
রামভক্তদের এই দেশে সীতার কথা, সীতাদের কথা যে কৌশলে চাপা দেওয়া হয়, তা তিনি টের পেয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, সীতার এই কথা আসলে তো ক্ষমতার উলটো বয়ান। যে ক্ষমতার ধারক ও শাসক রাম, তার বিপরীতে, ক্ষমতার ওপিঠে যারা থাকে, তাদের কথা তো হারিয়েই যায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সেই হারিয়ে যাওয়া কথাকেই ধরে রেখেছেন মেয়েরাই। পিতৃতন্ত্রের পরিসরে যাঁরা নিজেদের স্বর খুঁজে পান না, হারিয়ে যাওয়া কথাকে তো তাঁরাই চিনতে পারেন। তাই এক অন্য রামায়ণের স্রোত বয়ে চলে ভারতের অন্দরমহলে- বাংলা থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা থেকে কেরল সর্বত্র। যে রাম কেবল বীরত্বের প্রতীক, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সুখদুঃখ যাঁর কাছে গৌণ হয়ে যায়, সেই রামের কথা পাশে সরিয়ে সেইসব প্রত্যাখ্যানের, বিরহের, অসহায়তার মানবী মুহূর্তের গানই গেয়ে ওঠেন অনেক, অনেক মেয়ে। এক দেশ এক রামের নামে সেই অন্য রামকথা যাতে হারিয়ে না যায়, তেমনটাই তো চেয়েছিলেন নবনীতা।
-: আরও শুনুন :-
কবিতা মাথায় এলে আভেন নিভিয়ে লিখে নেব, বলেছিলেন দেবারতি
কিন্তু সেই আড়ালের কথাকে যখন কেউ সামনে টেনে আনেন, তখন কী হয়? ক্ষমতা যে কথাকে দমিয়ে দিতে চাইছে, সেখানে প্রতিবাদের স্বর তার সহ্য হয় না। প্রতিবাদীর দিকে ধেয়ে আসে হুমকি, আসে শাসানি। ১৯৯৭ সালে তাঁর ‘বামাবোধিনী’ উপন্যাসে সে কথাই বলছেন নবনীতা। তাঁর মতোই, এ উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র অংশুমালা সংগ্রহ করে চলেছিল সীতার বয়ানে এই ভিন্ন রামকথাকে। এখানেও সেই রামায়ণের সঙ্গে জুড়ে থাকা লেখিকা-গায়িকাদের ব্যক্তিক অনুভবকে চিনিয়ে দেন নবনীতা। কিন্তু অংশুমালার সেই ঝোঁক দেখে ভয় পায়, বিরক্ত হয় তার স্বামী। বলে-
যখন সারাটা দেশ রাম রাম করে খেপে রয়েছে, ঠিক তক্ষুণি তোমাকে প্রবন্ধ লিখতে হল কোন দেশের রামায়ণে রাম সীতার দাদা, আর কোন দেশের রামায়ণে সীতা রাবণের মেয়ে, আর কোন দেশের রামায়ণে বাল্মীকি সীতার প্রেমিক-কাম-পালকপিতা, আবার কোথায় যেন রাম-লক্ষ্মণ দুই ভাই-ই সীতাকে নিয়ে সুখে ঘরকন্না করেন— দ্রৌপদী স্টাইলে— রামভক্তরা এসব নোংরা কথায় খেপে উঠবে না ভেবেছ?
কিন্তু অংশুমালা ভয় পায়নি। ভয় পাননি নবনীতাও।
১৯৯৭ সালে যখন তাঁর এ উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছে, তার আগেই বাবরি-কাণ্ড নিয়ে হিন্দুত্ববাদের উগ্র প্রকাশ দেখেছে দেশ। যে উগ্রতা আসলে মানুষী অনুভবকে ধর্তব্যের মধ্যেই ধরে না। অনুভবহীনতা তো আসলে চূড়ান্ত নির্মমতারই শামিল। রাজনৈতিক পরিসরে এই যে রামতন্ত্র, তা তো কোনও না কোনও ভাবে লুকিয়ে রয়েছে আমাদের সামাজিক পারিবারিক ক্ষেত্রেও। যেখানে ক্ষমতার অপর পিঠে থাকে মেয়েরা, আর সেই সংখ্যালঘুদের অনুভূতিকে নিরন্তর পিষে দেওয়া হয়। মেয়েদের কথায় সুরে যে অন্য রামায়ণগুলি, তা ঠিক মেয়েদের এই ঘরোয়া সুখদুঃখগুলিকেই তুলে আনছে, বড় বড় যুদ্ধবিগ্রহে তার প্রয়োজন নেই। তাই নবনীতা মনে করেছিলেন, যে রামকথা নিষ্করুণ, যা নির্মমতার পক্ষে লাগাতার সওয়াল করছে, সেই রামকথার বিরুদ্ধে লড়তে গেলে ওই মায়াঘেরা অন্য রামায়ণই হয়ে উঠতে পারে একরকম আয়ুধ।
তিনি না থাকলেও, তাঁর সেই ভাবনা যে এই সময়েও সমান প্রাসঙ্গিক, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই অর্থে উইমেন স্টাডিজের চর্চা যখন সেভাবে শুরু হয়নি, তখন নবনীতা ধারাবাহিক ভাবেই এই কাজগুলি করে গিয়েছিলেন।
দেখার রকমফের, ক্ষমতাকে প্রশ্ন ধরনটি যে নারীর জীবনের সূত্র ধরেই প্রাসঙ্গিক করে তোলা যায়, সেই সরল অথচ বহুমাত্রিক পথটি বাংলা ভাষায় খুলে দিয়েছিলেন নবনীতাই।