কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে বিনোদ ঘোষালের তিন খণ্ডের ধ্রুপদি উপন্যাস ‘কে বাজায় বাঁশি‘। বিদ্রোহী কবির জন্মদিনে সংবাদ প্রতিদিন শোনো-তে তারই এক অংশ।
পাঠ: চৈতালী বক্সী
আজ সারাদিন ঘাড় গুঁজে লিখছে নজরুল। সেই সকাল থেকে লেখা শুরু করেছে, এখন বিকেল গড়িয়ে গিয়েছে কোনও হুঁশ নেই। পাতার পর পাতা লিখে চলেছে নবযুগের জন্য। মুজফফর সকালেই বেরিয়ে গিয়েছেন। আজ প্রেস রেডি করবেন। আরও অনেক কাজ রয়েছে। নজরুলকে বলে গিয়েছে লেখাগুলো যেন তৈরি করে রাখে। কাল পরশুর মধ্যেই কম্পোজ করতে দিয়ে দেবেন।
দুপুরে অল্প কিছু খাওয়ার জন্য উঠেছিল, তারপর আবার লিখতে বসে গিয়েছে। বাইরে সন্ধে নামার ঠিক আগে সিঁড়ি থেকে পবিত্রর গলার আওয়াজ। নুরু আছ? নজরুল…
আজ মোহিতলাল মজুমদারের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল, মনে পড়ল নজরুলের। হ্যাঁ, চলে এসো।
চলো ওঠো, এবার বেরোতে হবে।
মোহিতবাবু?
না অন্য জায়গায় আরজেন্ট কল এসেছে। তোমার নাম দেখছি আলোর গতিতে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। জয় হোক আমাদের হাবিলদার কবির।
তাই? আবার কে নাম করলেন? কলম আর কাগজের গোছা পাশে সরিয়ে রাখল নজরুল। বাঁ হাতে চায়ের কাপ ধরা।
ছন্দের জাদুকর, আমাদের সকলের প্রিয় সত্যেনদা কাল তোমার কথা বলছিলেন। তোমাকে দেখতে চেয়েছেন।
সত্যেনদা মানে? সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত?
হ্যাঁ ভাই। আর কে?
হুর্ রে, বলে হাতে ধরা চায়ের কাপটা শূন্যে উড়িয়ে দিল নজরুল। খানিক চা সমেত মেঝেতে খানখান হয়ে ছড়িয়ে পড়ল কাপটা। সত্যন্দ্রনাথের কবিতা নজরুল পাগলের মতো ভালোবাসে। বারবার বলে সত্যেনবাবু মানুষ নয়, বাংলা কাব্যে ছন্দের ঈশ্বর। সেই ঈশ্বর তাকে ডাক পাঠিয়েছেন। এ কি স্বপ্ন না সত্যি!
কাপের টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে পবিত্র বলল, গেল আরেকটা।
নজরুলের সেই হুঁশ নেই। তড়াক করে তক্তপোশ ছেড়ে উঠে গায়ে পাঞ্জবি গলিয়ে নিয়ে বলল, চলো চলো, শুভ কাজে দেরি করে লাভ নেই।
দাঁড়াও দাঁড়াও, এখনও হাতে একটু সময়ে রয়েছে। এক কাপ চা খাই। তারপর বেরোনো যাবে। আর কি আস্ত একটাও কাপ রয়েছে? নাকি নিচ থেকে ভাঁড় নিয়ে আসতে হবে?
চা ঐ কেটলিতে রয়েছে। একটু আগেই দিয়ে গেল, গরমই রয়েছে। নিয়ে নাও। বলল নজরুল। তারপর তক্তপোষের নিচে রাখা একটা কাপ ওর দিকে এগিয়ে দিল। কাপের ডাঁটি নেই। এই একটি রয়েছে খাওয়ার মতো।
কেটলি থেকে ডাঁটিভাঙা কাপে চা ঢলল পবিত্র। এক চুমুক দিয়ে আঃ শব্দ করে বলল, আজ দুপুরে অফিস থেকে গিয়েছিলাম কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে গজেনদার আড্ডায়। বাড়িতে ঢোকার মুখেই দেখি রোয়াকে বসে গজেনদা আর সত্যেনদা গল্প করছে। বুঝলাম আসল আড্ডার পূর্বপ্রস্তুতি চলছে। আমি গিয়ে বসে পড়লাম দুই মহারথীর পাশে।
গজেনদা কে? সাহিত্যিক নাকি?
আরে না না, হেসে উঠল পবিত্র। গজেনদার নাম হল গজেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ। একেবারেই সাহিত্যিক নন, বিলিতি সদাগরি অফিসের ক্যাশিয়ার। কিন্তু সাহিত্যঅন্ত প্রাণ, খুব দিলদার মানুষ। ওর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়িতে প্রতিদিন সাহিত্যিকদের আড্ডা বসে। অনেকেই আসেন হাজিরা দিতে।
সে আসুক, চা আর পান আসে কি? জিজ্ঞাসা করল নজরুল।
হুঁ- চা, পান, সিগারেট তো আসেই, তা ছাড়া হেমেনদা, বুড়োদা মানে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, মোহিতলালবাবু, আরও অনেকেই আসেন। পুরো জমজমাট আড্ডা বসে প্রতিদিন। তো কাল আমি সত্যেনদার পাশে গিয়ে বসামাত্র উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হে পবিত্র, এই শাতিল আরব এর কবি থাকেন কোথায়? তাই শুনে আমি হতবাক। তোমার লেখা শাতিল আরব কবিতা সত্যেনবাবু কখন পড়লেন! শুধু তাই নয়, পড়ে আবার মনেও রেখেছেন! আমার হাঁ করা মুখ দেখে তিনি আবার বললেন, আবার এমন হাঁ করে রয়েছ কেন পবিত্র, আমি নিয়মিত মোসলেম ভারত পড়ি, শুধু পড়ি বললে ভুল হবে, প্রতি সংখ্যায় ওই নজরুল ইসলাম ছোকরার কবিতা খুঁজি। ওর লেখার নেশায় পড়ে গিয়েছি বলতে পার। কী অনবদ্য মিল আর ছন্দ ছেলেটির হাতে! বলে গজেনদার দিকে তাকিয়ে বললেন, বুঝলেন গজেনদা, আরবি আর পার্সি ভাষাকে বাংলা ভাষার সঙ্গে এমন জোরদার ছন্দে মেলাতে আমি আগে কোনও কবিকে দেখিনি। কী জোরালো দৃষ্টিভঙ্গি। আমি এখন প্রায় সব পত্রিকাতেই এই ছেলেটির কবিতা খুঁজে বেড়াই।
[কৃতজ্ঞতা: কে বাজায় বাঁশি। বিনোদ ঘোষাল। প্রকাশক: মিত্র ও ঘোষ]
বাকি অংশ শুনে নিন লিংকে।