কাজ-চালানো গোছের সাংবাদিকতা তিনি করতে চাননি। চাননি আপসের পথে হাঁটতে, কিংবা ভয় পেয়ে থেমে যেতেও। সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ যখন চারদিকে জেগে আছে, সে সময়ে গৌরকিশোর ঘোষকে তাই ফের মনে করতে হয় আমাদের।
যদি প্রয়োজন পড়ে, তবে সরকার আর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলাই সাংবাদিকের কাজ। এ কথা মনে করতেন গৌরকিশোর ঘোষ। সেই ভারতেও তিনি এ কথাকেই আঁকড়ে ধরে ছিলেন, যে ভারত জরুরি অবস্থার সাক্ষী। সেই জরুরি অবস্থার দেশ তাঁকে উপহার দিয়েছিল কারাবাস। নিজের দেশে, স্বাধীন দেশের পুলিশ আর প্রশাসনের কাছ থেকে জুটেছিল লাঞ্ছনা। তবুও, সাংবাদিকতার সঙ্গে আপসকে না জুড়ে দেওয়ার পক্ষেই জীবনভর সওয়াল ছিল গৌরকিশোরের। এমনকি, কেবল প্রত্যক্ষ আপস নয়, পক্ষ না নেওয়ার প্রতিও সমর্থন ছিল না তাঁর। তিনি মনে করতেন, মনে রাখতে বলেছিলেন যে, “নিষ্ক্রিয়তাও পাপ, কেননা তাও সহযোগিতাই।” জরুরি অবস্থার সময়ে যখন তিনি কারাবন্দি, তার আগেকার সময়টা জুড়েই নকশাল আন্দোলন আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পাশাপাশি চলেছে। আর এই সমস্ত সময়টা জুড়েই কলম চলেছে এই নির্ভীক সাংবাদিকের। গণতন্ত্রের ‘মৃত্যু’ হয়েছে বলে মাথা কামিয়ে অশৌচ পালন করেছেন তিনি। ‘পিতার পত্রে’ তিনি লিখলেন, “আমি মনে করি আমার লেখার অধিকার, আমার মত প্রকাশের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার অর্থ আমারও অস্তিত্বকে হত্যা করা।”
যে যুদ্ধের দুনিয়ায় সাংবাদিকেরা প্রতিনিয়ত বিপন্ন হচ্ছেন, প্রতিদিন গণমাধ্যমের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, সেই সময়ে জরুরি হয়ে দাঁড়ায় অতীতের এই পাঠ। আমাদের মনে পড়ে, ২০২১ সালে, তালিবান যখন ফের আফগানিস্তানের দখল নিচ্ছে, সেই সময়েই ওই সংঘাতের খবর করতে গিয়ে নিহত হন ভারতীয় চিত্রসাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকী। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজার হত্যালীলা, এমনকি ইদানীং কালের বাংলাদেশ- কোথায়ই বা নিরাপদ রয়েছেন সাংবাদিকেরা! একেবারে সাম্প্রতিক এক আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট বলছে, শুধু ২০২৪ সালেই কাজ করতে গিয়ে বিশ্বজুড়ে ৫৪ জন সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে। শুধু তো মৃত্যু নয়, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের প্রবণতা তো দেশে দেশে কালে কালে চলছেই। রিপোর্ট অনুযায়ী, চলতি বছরে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বে ৫৫০ জন সাংবাদিককে বন্দি করা হয়েছে। এখনকার বাংলাদেশের কথাই যদি ধরি, জানা যাচ্ছে খোদ অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (এপি) ব্যুরো চিফ-সহ ১৮৪ জন সাংবাদিকের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করে দিয়েছে ইউনুস সরকার। এ দেশে হাথরাসের নির্যাতিতাকে নিয়ে খবর করতে গিয়ে জেলে বন্দি হয়েছেন সিদ্দিক কাপ্পান। সরকারকে প্রশ্ন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন মহম্মদ জুবেইর। মিসায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্তরা; যেমন এখনও ইউএপিএ-তে গ্রেপ্তার হচ্ছেন কাপ্পান-জুবেইররা। অথচ আমরা জানি, সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ, আর প্রত্যেক ব্যক্তির মতপ্রকাশের অধিকার থাকাই গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত। যে শর্তকে ভিত্তি করেই সাংবাদিকতার এগোনো। ২০২১ সালে যখন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন দুই সাংবাদিক মারিয়া রেসা এবং ডিমিট্রি মুরাটভ, সে সময় নোবেল কমিটি সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছিল নতুন করে। মনে করিয়েছিল, যে কোনও ক্ষমতাদর্পী শাসক সবসময়ই তাঁর অধীন স্তর থেকে উঠে আসা স্বরগুলিকে রুখে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে দেশকে রক্ষা করতেই সাহায্য করে স্বাধীন ও নির্ভীক সাংবাদিকতা। আর গৌরকিশোর ঘোষের মতো সাংবাদিকেরা জীবনভর সেই ভয় না পাওয়ার পাঠ দিয়ে গিয়েছেন।
জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সাংবাদিকতার জেরে জেলে যেতে হয় গৌরকিশোরকে। অথচ তার আগে নকশাল আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন নকশালদের কোপেও পড়েছিলেন তিনি। আদর্শের কথা বলে খুনের রাজনীতি তিনি মানতে পারেননি। তার বিরুদ্ধেও কথা বলেছিল তাঁর কলম। বদলে জুটেছিল খুন হয়ে যাওয়ার ভয়। গৌরকিশোর কিন্তু লেখাও থামাননি, নকশালদের মুক্তাঞ্চল বরানগর ছেড়ে অন্য কোথাও যেতেও রাজি হননি। আবার ‘রূপদর্শী’র কলমে সেই গৌরকিশোর এ কথা লিখতেও ছাড়েননি, যে, পুলিশ যেভাবে নকশাল-নিধন চালাচ্ছে তা অমানবিক। প্রেসিডেন্সি জেলের দশ নম্বর সেল থেকে তাঁর যে দুটি লেখা ছড়িয়ে পড়েছিল, তার প্রথমটি প্রধানমন্ত্রীকে ফ্যাসিবাদ বিষয়ে পাঠ, কারণ তখন ইন্দিরা গান্ধী নিজেকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন। সেখানে গৌরকিশোর মনে করিয়ে দেন, ফ্যাসিবাদের একটি বিশেষত্বই হল, ‘দলীয় নেতাই দেশ’- ‘এই অহমিকাকে নিরঙ্কুশ প্রশ্রয়দান’। সেই প্রশ্রয় কোনও মানুষকে একরকম দেবত্বে উন্নীত করে, যা গণতন্ত্রের পক্ষে সুখকর নয়- ‘নেতাজী পূজা ১৯৯৭’ সংবাদে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন গৌরকিশোর।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর গৌরকিশোর লেখেন তাঁর বিখ্যাত বই, ‘আমাকে বলতে দাও’। সাংবাদিক তো বটেই, মানুষ হিসেবেই এই বলার অধিকার যে একান্ত মৌলিক অধিকার, সে কথায় বিশ্বাস ছিল তাঁর। তবে সাংবাদিক হিসেবে তিনি এ কথাও মনে করতেন যে, সাংবাদিকের বলা হবে অন্যরকম। আর পাঁচজন মানুষ যা দেখবে না, যা বলবে না, সাংবাদিক আসলে সেই ছবি খুঁজে সে কথাই বলে উঠবেন। সেই অন্তর্ভেদী অভ্যাসই তাঁর লেখাকে বাড়তি সমীহ জুগিয়েছে। তাই রাজ্য সরকার যখন ত্রাণ কর্মসূচি উপলক্ষে সাংবাদিক দলকে জেলায় নিয়ে যান, সেখানে দরিদ্র খেতমজুরদের আর্থিক সাহায্য পাওয়ার ছবি ওঠে, মন্ত্রী-আমলাদের উচ্ছ্বসিত ছবি ওঠে, আর গৌরকিশোর ঘোষ লেখেন, ‘দুইল্যা শেখের কপাল ফিরল!’ তাঁর রিপোর্ট থেকে দেখা গেল, সরকারি সাহায্য নেবেন বলে জনৈক দুইল্যা শেখ একদিন আগে দূর গ্রাম থেকে বাসে চেপে জেলা শহরে এসেছেন। রাতে হোটেলে থাকা আর দুবেলা খাবার খাওয়ার খরচ লেগেছে তাঁর। পরদিন দুপুরে সরকারি সাহায্যের টাকা নিয়েছেন এবং সেই রাতও বাধ্য হয়ে হোটেলে থেকে-খেয়ে তৃতীয় দিন বাসে চেপে ফিরে গিয়েছেন। তাতে তাঁর যা খরচ হয়েছে, সরকারি সাহায্যে সেই খরচ পোষায়নি।
সাংবাদিক হিসেবে এই অন্যরকম দেখা-বলার দায় অনুভব করেছিলেন গৌরকিশোর। সে কারণেই আপসের পথ তিনি বেছে নিতে পারেননি কখনই। পারেননি থেমে যেতেও। তারপরেও, ১৯৯০ সালে ভাগলপুরে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার পর তিনি বাদল বসুকে লেখেন, “যে ধরনের সাংবাদিকতা আমরা করে চলেছি, এতে আমার আস্থা চলে গিয়েছে। সেই জন্যই কিছুদিন থেকে ভাবছিলাম, এবার ইস্তফা দেবার কথা ভাবি। অন্য কিছু করি। ভাগলপুরের ঘটনা আমাকে পথ দেখিয়ে দিল। এখনও কিছু করা যায়।”
সেই অন্যরকম করার পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ। কিন্তু চারদিকের আপস-রফার মাঝে দাঁড়িয়ে সেই একলা চলার পথ আমরা চিনতে চাই কি আর? প্রশ্ন এখানেই।