পুরুষ লেখকরা পুরুষ চরিত্রকে কেন্দ্র করে লিখতেই পারেন। তাহলে নারীরা মেয়েদের কথা লিখলে কেন তাঁদের ‘মেয়েলি’ বলেই আলাদা খোপে সরিয়ে দেওয়া হবে? প্রশ্ন তুলেছিলেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য। ‘মেয়েলি লেখিকা’র স্টিরিওটাইপে তাঁকে বেঁধে ফেলার আয়োজন ছিল বরাবরই, কিন্তু সেই গণ্ডিকে তোয়াক্কা না করেই বাংলা সাহিত্যে দাপটের সঙ্গে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন জনপ্রিয় এই লেখিকা। লিখছেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
এ নিশ্চয়ই কোনও মেয়ের লেখা নয়। নির্ঘাত কোনও পুরুষ লিখছেন ছদ্মনামের আড়ালে। – সুচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখা পড়ে গোড়ার দিকে নাকি এমনটাই ভেবেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এত জোরালো লেখা সচরাচর কোনও পুরুষের কলমেই আসা সম্ভব, এ কথার আড়ালে কি এমনই এক ভাবনা নিহিত ছিল তাঁর? সে উত্তর হয়তো মিলবে না আর। তবে পরবর্তী কালে সুচিত্রা ভট্টাচার্য নিজেই জানিয়েছিলেন, ‘তোমার লেখাটা বেশ পুরুষালি’- এ কথা শুনলে মজাই লাগে তাঁর। জানিয়েছিলেন, সাহিত্যজগতের কোনও কোনও তাবড় মানুষের কাছ থেকেও এহেন কথা শুনতে হয়েছে তাঁকে।
আরও শুনুন: ‘মেয়েলি লেখিকা’ তকমা নিয়েই আশাপূর্ণা তুলে ধরেছিলেন রুদ্ধস্বরের কথকতা
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের পাতা ওলটালে দেখা যাবে, এমন ভাবনা আদৌ নতুন নয়। স্বর্ণকুমারী দেবী যখন উপন্যাস লিখছেন, তখনও অনেকে ভাবতে পারেননি যে এ লেখা কোনও নারীর। একই কথা খাটে সরলা দেবীর ক্ষেত্রেও। যেহেতু মেয়েদের শিক্ষার চল শুরু হয়েছিল পরে, ফলে মেয়েদের লেখালিখি শুরু হতে সময় লেগে গিয়েছিল আরও অনেকখানি, ফলে মেয়েদের প্রথম পর্বের লেখালিখির মধ্যে খানিক আড়ষ্টতা ছিলই। কিন্তু নারীর লেখা মানেই তা নরমসরম, এলিয়ে পড়া- বহুদিন পেরিয়ে এসেও এমনই এক প্রোটোটাইপ কায়েম হয়ে ছিল সাহিত্যের দুনিয়ায়। যে কথাটির বিরুদ্ধে লিখে, বলে, বারেবারেই সরব হয়েছেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য। আসলে সাহিত্যের দুনিয়ায় যে নারী আর পুরুষের একটা স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে, সে কথা তো একেবারে অজানা নয়। কোনও নারী যদি লেখালিখি করেন, তাঁকে কেবল লেখকের পরিচয়টুকু দিয়ে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না, তাঁকে মহিলা লেখক কিংবা মহিলা কবি এমন বিশেষ তকমা যেন দিতেই হয়। আবার তাঁর কলমে যদি মেয়েদের কথাই বেশি করে উঠে আসে, তখনও শোনা যায় আরেকরকম অভিযোগের সুর। বলা হয়, তিনি বড় বেশি ‘মেয়েলি’। তিনি কেবল মেয়েদের কথাই বলেন আর মেয়েদের জন্যই কথা বলেন। চৈতালী দাশগুপ্তকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একটু ক্ষোভ প্রকাশ করেই তিনি বলেছিলেন, “সাহিত্যের ইতিহাসের বই খুললে দেখা যায়, একটা আলাদা ‘হারেম’ রয়েছে মহিলা সাহিত্যিকদের জন্য।” তিনি তো বটেই, তাঁর পূর্বসূরি কিংবা সমসাময়িক যে নারীরা লিখেছেন, লিখছিলেন, তাঁদের জন্য কেন একটা আলাদা খোপ বরাদ্দ করতে হবে, এ কথা বুঝতে পারেননি জনপ্রিয় এই লেখিকা।
যদিও, জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রেও যে এই আলাদা খোপটি তাঁর জন্যে বরাদ্দ ছিল, সে কথাও জানতেন সুচিত্রা। এক সাহিত্যসভায় উপস্থিত ছিলেন তিনি। সেখানে ছিলেন বাণী বসু, যশোধরা রায়চৌধুরীর মতো আরও একাধিক লেখিকা, যাঁদের লেখালিখির ভাঁড়ারটি বিপুল। একইসঙ্গে তাঁরা জনপ্রিয়ও বটে। সেখানেই নিজের লেখালিখির অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে সুচিত্রা বলেছিলেন, আমার কাছে এসে অনেক ভদ্রলোক আলাপ করেন। কেউ উকিল কেউ ডাক্তার কেউ ইঞ্জিনিয়ার। তাঁদের মুখে একটাই কথা থাকে, আমার স্ত্রী আপনার খুব ফ্যান, আপনার সব লেখা পড়েছে। একটা সই দেবেন? এ কথা জানিয়েই সুচিত্রা প্রশ্ন তুলেছিলেন, আচ্ছা, ওঁরা নিজেরাও আমার লেখা পড়েন নিশ্চয়, নইলে এত বিক্রি হয় কী করে? তাহলে স্বীকার করতে কেন লজ্জা? শুধু পাঠকরাই নন, লেখকদের কাছেও তাঁর প্রশ্ন ছিল, পুরুষকে প্রধান চরিত্র করে পুরুষ লেখকেরা তো ভূরি ভূরি লেখা লিখে যান। সেখানে পুরুষের চোখ দিয়ে স্বপ্ন দেখা হয়। পুরুষের আশা আকাঙ্ক্ষা সুখ দুঃখ যন্ত্রণার কথা বলা হয়। সে পুরুষ কোনও নারীর প্রেমে পড়ে, কোনও নারীকে প্রেমের চোখে কল্পনাও করে। কিন্তু এই পরিসরে প্রশ্ন ওঠে না যে, কেবল পুরুষদের কথা লেখা হচ্ছে কেন! তাহলে মেয়েদের কথা লেখাকে আলাদা করে কেন চিহ্নিত করতে হবে, অভিযোগের সুরেই এ প্রশ্ন রেখেছিলেন সুচিত্রা।
আরও শুনুন: খেলা নিয়ে লেখা মানেই লেখা নিয়ে খেলা নয়, বুঝিয়েছিলেন মতি নন্দী
সুচিত্রা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, যে, কেবল পুরুষ বা কেবল নারীর কথা বলা সাহিত্যের পক্ষে সম্ভব নয়। সে সকলের কথাই বলে। কিন্তু নিজের লিঙ্গপরিচয়ের দরুন মেয়েদের যন্ত্রণা চেনা যে তাঁর পক্ষে সহজ, সে কথা অস্বীকার করতে চাননি তিনি। তাই নানারকম ভাবে মেয়েদের কথা বলে যেতেও চেয়েছিলেন এই লেখিকা। যে কথা মেয়েদের বুকে জমে ওঠে, কিন্তু বুক ফাটলেও তা মুখ ফুটে বেরোনোর পথ পায় না, সে কথাগুলিকে খুঁজে খুঁজে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। ‘মেয়েলি লেখিকা’র স্টিরিওটাইপে তাঁকে বেঁধে ফেলার আয়োজন ছিল বরাবরই, কিন্তু সেই গণ্ডিকে তোয়াক্কা না করেই বাংলা সাহিত্যে দাপটের সঙ্গে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য।