সমকাল ও সমাজের যে ছবি অস্বস্তিতে ফেলে, শন্দে অক্ষরে সেই ছবিই বরাবর সাজাতে চেয়েছিলেন সুবোধ ঘোষ। রাজনৈতিক ডামাডোলের কথাও বলেছেন আড়াল আবডাল না রেখেই। কিন্তু তা করতে গিয়েই কি উঠেছিল সরকারবিরোধিতার অভিযোগ?
যুদ্ধপরিস্থিতিতে শত্রুপক্ষের কাছে নাকি সরকারবিরোধী গোপন তথ্য পাঠিয়েছেন, এমনই অভিযোগের আঙুল উঠেছিল খোদ সুবোধ ঘোষের দিকে। তাঁর বই ছাপলে জেল হতে পারে বলে ভয় পেয়েছিলেন প্রকাশকও। স্পষ্ট কথা বলতে গিয়েই কি সরকারবিরোধিতার অভিযোগ উঠেছিল তাঁর নামে?
-: আরও শুনুন :-
যাহা জল তাহা পানি নয়! ‘মুসলমানী শব্দ’ ব্যবহার নিয়ে কী মত ছিল রবীন্দ্রনাথের?
সাহিত্যিক হিসেবে ততদিনে তিনি প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তিনি যে কোনও দিন লেখালিখি করবেন, এমন কথাই ভাবেননি। বন্ধুদের এক মজলিশি আড্ডায় নিয়মিত নিজেদের লেখা পাঠ করতেন সকলেই, ব্যতিক্রম একমাত্র সুবোধ ঘোষ। অন্যদের লেখা শোনা আর পেটপুজোয় শামিল হওয়া, এই ছিল আড্ডায় তাঁর রুটিন। কিন্তু একসময় অনুরোধের সুরেই বলা হল, তিনি নিজেও কিছু লিখুন এবার। পরে আত্মজীবনীতে সুবোধ লিখেছেন, “বুঝতে দেরি হয়নি আমার, নিজের কোন লেখা পাঠ না করে শুধু খাওয়া-দাওয়া করা ভাল দেখায় না। সুতরাং অনামী সঙ্ঘের পরবর্তী দুই বৈঠকে নিজের লেখা দু’টি গল্প পড়লাম।’ সেই দুটি গল্প, ‘অযান্ত্রিক’ ও ‘ফসিল’ বাংলা সাহিত্যে ঠাঁই করে নিল প্রথম আবির্ভাবেই, একইসঙ্গে তাদের স্রষ্টাকেও এনে দিল সাহিত্যিকের আসন। সে আসন এতটাই পাকা, যে, নামী পত্রিকায় নিজে উপন্যাস লিখতে চেয়েও তাঁকে ফিরে আসতে হয়নি। সেসময় শুরু হয়ে গিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বাইরের শত্রুর আক্রমণের ভয়ে কাঁপছে বাংলাও। একইসঙ্গে দেশের ভেতরেও তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জোয়ার। সরকারের কড়া দমন নীতিতে জেলবন্দি অনেক নেতাই। তার উপরে দেশের মধ্যে ঘনিয়ে উঠছে একাধিক রাজনৈতিক বিশ্বাসের চাপানউতোর, একইসঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিষ। সেই অস্থির পরিস্থিতির তাড়া থেকেই যেন রুখে উঠেছিলেন সুবোধ। লিখতে শুরু করেছিলেন প্রথম উপন্যাস, ‘তিলাঞ্জলি’।
-: আরও শুনুন :-
হিন্দু বিধবার সঙ্গে মুসলিম ছেলের প্রেমের উপন্যাস লিখতে দ্বিধা করেননি শৈলবালা ঘোষজায়া
লেখক নিজেও একথা জানতেন, ‘উপন্যাসে ব্রিটিশরাজ ও কম্যুনিষ্ট পার্টির কথা কাজ ও নীতির প্রতিবাদ আছে। জাতির স্বাধীনতার দাবি ও সংগ্রামের সমর্থন ও প্রশস্তি আছে। সুতরাং কম্যুনিস্ট পার্টির মানুষ এবং যাঁরা পার্টির অনুগতজন তাঁরা তিলাঞ্জলির প্রতি বিদ্বিষ্ট হবেন, এটা স্বাভাবিক।’ কিন্তু সময়ের ভিতর মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে সেই সত্যিটুকুই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। তার মাশুল হিসেবেই হয়তো, প্রথম উপন্যাস যখন বই হিসেবে প্রকাশ পেতে চলেছে, তখনও প্রকাশকের কাছে এল হুঁশিয়ারি। এ বই ছাপলে ভারত রক্ষা আইনে জেল হতে পারে। সব বাধা পেরিয়ে বই যদি বা প্রকাশ পেল, তারপর খোদ লেখকের জুটল শত্রুপক্ষের গুপ্তচরের তকমা। দেশজোড়া বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতির মধ্যেই তলব এসেছিল, আইসিএস মিঃ রাওয়ের সঙ্গে দেখা করতে হবে। তখন সদ্য হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন সুবোধ ঘোষ। আসলে এই রাওয়ের কাঁধে সুবোধ ঘোষের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানোর দায়িত্ব পড়েছিল। দেখা হতেই তিনি জানালেন, সরকারের কাছে অভিযোগ এসেছে, আসামে গিয়ে শত্রুপক্ষ জাপানের সামরিক গোয়েন্দাদের সাহায্য করেছেন সুবোধ ঘোষ। অনেক খবরও জুগিয়ে দিয়েছেন তাদের। অথচ কস্মিনকালেও আসামে যাননি সুবোধ। দৃঢ় গলায় সে কথা জানাতেই অবশ্য কাজ হয়েছিল। একটি সই করিয়েই খ্যাতনামা লেখককে রেহাই দিয়েছিলেন সেই তদন্তকারী অফিসার।