হাসির রাজা বলেই খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী। কিন্তু সেই রসিক শিবরামই আবার পরাধীন দেশের জন্য হাতে তুলে নিয়েছিলেন বন্দুক। পড়েছিলেন পুলিশের নজরেও। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সেই অন্য শিবরামের কথা।
ছোটবেলায় স্কুলে প্রবন্ধ লিখতে দিয়েছিলেন মাস্টারমশাই। বিষয়, বড় হয়ে কী হতে চাও? সেখানে একটি ছেলে লিখেছিল, দেশপ্রেমিক হতে চাই। সেই ছেলেটিই শিবরাম চক্রবর্তী। যদিও শিবরাম এমন এক পরিবারের সন্তান, যা একদিকে রাজবংশের অন্তর্গত, আরেকদিকে চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক। কিন্তু বারেবারে বাড়ি থেকে পালানো আর দেশকে কাছ থেকে দেখার সুযোগেই হয়তো দেশ আর দেশবাসীর পরাধীনতার জ্বালা বুঝতে পেরেছিল সেই কিশোর। তাই ওই প্রবন্ধ লেখার সূত্রেই যখন ডাক এসেছিল স্বদেশী দলে যোগ দেওয়ার, দ্বিধা না করেই রাজি হয়ে যান শিবরাম। পুলিশের চোখ এড়াতে সেখানে কিশোরদের হাতে গোপনে পাচার করা হয় চিঠি আর অস্ত্র। তেমনটা চলতে চলতেই একদিন এল বড় কাজের নির্দেশ। স্থানীয় সভায় অতিথি হয়ে আসছেন এক সাহেব, গুলি করে হত্যা করতে হবে তাঁকে। পকেটে পিস্তল নিয়ে শিবরাম সেদিন জায়গামতো পৌঁছেছিলেন ঠিকই, তবে গুলি ছোড়ার আগেই মঞ্চে ডাক পড়েছিল উদ্বোধনী সংগীত গাওয়ার জন্য। ফলে ভেস্তে গিয়েছিল সেদিনের পরিকল্পনা।
আরও শুনুন: বাংলা গানে-সিনেমায় ‘কুমার’-এর ছড়াছড়ি, তবে সাহিত্যে স্বপনকুমারই একমেবাদ্বিতীয়ম
কিন্তু তা বলে স্বদেশির পথ থেকে সরে আসেননি শিবরাম। এবার আর সাহেব নন, সভায় এসেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। দেশবন্ধুর ভাষণ শুনে আর তাঁর পিছু ছাড়লেন না শিবরাম। তাঁর সঙ্গ ধরেই এসে হাজির হলেন কলকাতায়। লক্ষ্য একটাই, স্বদেশী দলে নাম লেখাবেন তিনিও। শুধু তাই নয়, জেলে যাওয়ার ইচ্ছেও কম নয়। শেষ পর্যন্ত সে ইচ্ছে মিটিয়েই ছেড়েছিলেন বইকি শিবরাম। তার উপরে জেলেই আবার দেখা হয়ে গিয়েছিল কিশোরবেলার প্রেমিকা রিনির সঙ্গেও।
তবে শিবরামের উপর পুলিশের নজর ছিল এরপরেও। শিবরামের মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের মেসে নাকি বিপ্লবীদের আসা যাওয়া, এমন অভিযোগ তো ছিলই। যুগান্তর-এ ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লেখা ছেপেও রাজরোষে পড়েছিলেন। সে কারণেই পুলিশ যখন তাঁর মেসে হানা দিয়েছে, শিবরাম সামনের মিষ্টির দোকানে রসগোল্লা খেতে ব্যস্ত। গ্রেপ্তার হলে অনেকদিন মিষ্টি জুটবে না যে! খেতে যে বরাবরই ভালোবাসতেন শিবরাম, সে কথা অবশ্য সকলেরই জানা। এমনকি তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন পুলিশের দারোগাও। একসময় দুঁদে দারোগা ও অপরাধ-বিষয়ক লেখক পঞ্চানন ঘোষালের উপর ভার পড়েছিল শিবরামের উপর নজরদারি চালানোর। কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের এক হোটেলে শিবরামের খোঁজ পেলেন বটে পঞ্চানন, কিন্তু তারপরেই ঘটল আরেক কাণ্ড। শিবরাম তাঁকে ডিনারের নেমন্তন্ন করে বসলেন। দুজনে খেলেনও একসঙ্গে। কিন্তু খাওয়ার পর বিল এল ১১ টাকা, যা সেকালের আনি-দুয়ানি-পয়সার যুগে রীতিমতো বেশি। শিবরাম খোলসা করে বললেন, বিল তো শুধু সেদিনেরই নয়, আগের কয়েকদিনের ধারও ওর মধ্যেই ধরা আছে। শিবরাম খাইয়েছেন, আর বিল মেটাবেন পঞ্চানন, সোজা হিসেব রসিক লেখকের। এ গল্পের অন্য রূপান্তরে অবশ্য এমন কথাও শোনা যায় যে, শিবরাম নিজের টাকায় খাবার খেলেও, বারে বারে হোটেল রেস্তরাঁয় ঢুকে তাঁর উপর নজরদারি চালাতে গিয়ে রীতিমতো মোটা হয়ে গিয়েছিলেন দারোগা নিজেই।
আরও শুনুন: ইংরেজি অনুবাদে নজরুলের গান শুনে মুগ্ধ গান্ধী, জেলে বসে গাওয়ার ইচ্ছে সুভাষের
নিজেকে সার্কাসের ক্লাউনের সঙ্গে তুলনা করে শিবরাম বলতেন, হাসির হলেই তাঁর খেলা হাসিল হতে পারে। তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে সেই রসিকতার আভাস। কিন্তু নিছক হালকা হাসি নয়, সেই রসবোধে ঘন হয়ে ছিল জীবনদর্শনও। আর সেই দর্শন উঠে এসেছিল শিবরামের আশ্চর্য জীবন থেকে। যে জীবনে অর্থের প্রতি লোভ নেই, খ্যাতির প্রতি মোহ নেই, অথচ জীবনকে চেটেপুটে নেওয়ার মতো মায়া জড়িয়ে আছে, সেই জীবনকেই দুহাতে জড়িয়ে নিয়েছিলেন এই আশ্চর্য মানুষটি।