নামী লেখক হবেন, ঠিক এমন কথা কি আগে ভেবেছিলেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়? বরং সন্ন্যাসী হওয়ার সাধ ছিল তাঁর। কিন্তু সিনে পত্রিকায় ছাপা হওয়া একটা গল্পই একসময় জীবন বদলে দিল তাঁর।
সাহিত্যিক মনে হয় কসরত করে হওয়া যায় না। কুস্তিগির হওয়া যেতে পারে।- এ কথা বলেছেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় নিজেই। কলেজবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে লেখালিখির আড্ডা জুড়তেন তিনি। কিন্তু লিখতেই হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। যেমন কী লেখা হবে, তা নিয়েও ছিল না কোনও বিধিনিষেধ। আসলে সাহিত্যিক হয়ে ওঠার কোনও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য যে ছিল না তাঁর। ছিল কেবল দেখার চোখ। ঠিকমতো জ্ঞান হওয়ার আগেই মাকে হারানো বালকের নিঃসঙ্গ চোখ কেবল সঙ্গ খুঁজে ফিরত চারপাশে। আকাশ, গাছ, মাঠ, পাখি, গঙ্গা, নির্জন মন্দিরে দীর্ঘ শিবলিঙ্গ, খোলা জানলায় সুন্দর মুখ, ঘাটের সিঁড়ি কিংবা নৌকার মাঝি- এই সবকিছুই হয়ে উঠত একেক মুহূর্তের সঙ্গী। আর সেই দেখা জীবনের কথাই লিখতে চেয়েছিলেন সঞ্জীব।
আরও শুনুন:
সত্যজিতের মতের বিপক্ষে যেতেও দ্বিধা করেননি সন্দেশ-এর ‘বড় সম্পাদিকা’
তবে সে লেখা তো খেয়ালখুশির লেখা। যাদের সঙ্গে মিলে লেখা বয়ে চলেছিল, জীবনের পথে চলতে চলতে একসময় দেখা গেল, বন্ধুদের সেই সাহিত্যচক্র মিলিয়ে গিয়েছে। সঞ্জীব নিজেই বলেছেন, “পড়ে থাকলুম আমি আর আমার গঙ্গা আর ইতিহাসের পদচিহ্ন। সবই তো হল, লেখার কী হল? হতেই হবে, এমন তো কোনও কথা নেই। লিখবে তো মন। সেই মন আরও খানিক জর্জরিত হোক। ব্লটিং পেপারের মতো আরও আরও দুঃখ-সুখ শুষে নিক জীবনপাত্র থেকে।” এই দুঃখসুখের খেলাতেই বোধহয় একসময় মন সরে গিয়েছিল রোজকার জীবনযাপন থেকেই। ছাত্রজীবন শেষ করে শিক্ষকতা করতে গেলেন দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠে। ততদিনে সঙ্গ খুঁজে নিয়েছেন রামকৃষ্ণদেব, মা সারদা আর স্বামী বিবেকানন্দের জগতে। ঠিক এক বছরের মাথায় সন্ন্যাসী হবেন, এই উদ্দেশ্য নিয়েই চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন যুবক সঞ্জীব। কিন্তু জীবন যে তাঁর জন্য অন্য কিছুই লিখে রেখেছিল। তাই বাবার অসুস্থতার খবরে ফিরে আসতে হল চেনা সংসারেই।
এই সময়েই প্রস্তাব এল লেখার। পাড়ার এক দাদা সিনে সাপ্তাহিক খুলেছেন, তিনিই স্নেহের অনুজকে ধরলেন সাহায্যের জন্য। সেই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হল সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম গল্প। তখন দেওঘরের চাকরি ছেড়ে কলকাতার এক বিখ্যাত রাসায়নিক সংস্থায় চাকরি নিয়েছেন তিনি। অপ্রত্যাশিত ভাবে লেখাটির প্রশংসা এল ঊর্ধ্বতন আধিকারিকের কাছ থেকে। কাজের লম্বা টেবিলে বুনসেন বার্নার আর রাসায়নিক নিয়ে যুদ্ধ চলছে, এমন সময় সেই আধিকারিক এসে পাশে দাঁড়ালেন। কানে কানে বললেন, ‘তোমার হবে। লেখা ছেড়ো না।’ পিঠে একটা হাত রাখলেন, আশীর্বাদের মতো। পরবর্তী জীবনে সঞ্জীব বলেছেন, সেই হাতটিই বুঝি তাঁকে সাহিত্যের পথে যাত্রা করতে ঠেলে দিয়েছিল।
আরও শুনুন:
পণ্যসভ্যতাকে উপেক্ষা করেই দৃশ্যের শিল্পে দেশের আত্মাকে চিনিয়েছেন সাহানি
অবশ্য এ চাকরিও বদলে গেল সময়ের সঙ্গে। কিন্তু নতুন চাকরি দেখার সুযোগ খুলে দিল চোখের সামনে। কিন্তু সে কোন দেখা! ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশের জন্য শহর থেকে শহরে ছোটাছুটি করছেন, এদিকে নকশাল আন্দোলনের আঁচে পুড়ছে দিনকাল। ক্রমশ লেখার মধ্যে ঢুকে পড়লেন সঞ্জীব। তাঁর ‘শ্বেতপাথরের টেবিল’ পড়ে স্বয়ং আবু সয়ীদ আইয়ুব ও গৌরী আইয়ুব চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘এই লেখক আর যদি কিছু না লেখেন তা হলেও বাংলা সাহিত্য তাঁর নাম থাকবে।’ এককালের সন্ন্যাসী হতে চাওয়া সেই মানুষটি রাজনীতি নিয়ে লিখেছেন ‘কলকাতা আছে কলকাতাতেই’। এই লেখার জন্যেই খুনের হুমকি পর্যন্ত এসেছে বারবার। কিন্তু লেখার জন্য আপস করার ইচ্ছে ছিল না বলেই নিজের দেখা জীবনকেই লিখতে চেয়েছিলেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “আমি কোনও দিনই হাসির গল্প লিখব ভেবে কিছু লিখিনি। আমি তো জীবন দেখে, জীবনের গন্ধ মেখে লিখতে চাই। অঙ্গভঙ্গি, ক্যারিকেচার করে লোক হাসানো যায়। কিন্তু লিখে হাসি ফোটানো একটু শক্ত কাজ।” তবে সেই শক্ত কাজও যে ভারি সহজে করা যায়, সে কথাও তো দেখিয়ে দিয়েছেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ই।