যে বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী, ভালোবাসা দিয়েই সেই অনড় বিন্যাসটাকে ভেঙে দিতে চেয়েছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। মুখ ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিল দেশের শিকড়ে। কোলাহল ঠোকাঠুকি পেরিয়ে একান্ত স্বদেশে পৌঁছতে চেয়েছিলেন যে কবি, মৃত্যুদিনে ফিরে দেখা তাঁর কবিতার মানুষকে।
স্মৃতি যখন মানুষের শরীর, তখন ‘হৃদয় স্মৃতি স্বদেশ বনগন্ধ’। স্মৃতি তো ছারপোকা। চেনা সিঁড়ি, প্লাস্টার খসে গেলে সেই ছারপোকার কিছু যায় আসে। কিন্তু মানুষের? যে মানুষ অন্ধ তার কিছুই যায় আসে না- ‘সে শুধু যা চেনে তার নাম ঐ কমোড, কেদারা, টেলিভিসটা, আর বারটনের ফ্রেম!’ ফলত বাড়িবদলের মধ্যে যে দুঃখ থাকে তা পোহায় বেড়াল। কিংবা বাড়িবদলে কোন সুখ আশা করে পাখি, জেগে থাকে সেই ক্ষীণ প্রশ্নচিহ্নও। তবু বেঁচে থাকা, শুধুই বেঁচে থাকা। এর ভিতরই ঘটে যায় অবিচার-
শিকড় মাটিতে বসে আর যেন বসে না কোথাও, এই ভেবে
মানুষ নিজের প্রতি বারবার অবিচার করে।
এই বাড়িবদলের কথা বারবার ফিরিয়ে আনেন কবি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। বাড়ি মানে স্মৃতি। বাড়ি মানে রক্তমাংস, মানুষ, বেঁচে থাকার সুঘ্রাণ উদযাপন। সেই বাড়ি বদলে যায়। সেই বাড়ি ছেড়ে গেলে চিঠি ফিরিয়ে দিয়ে যায় পিওন। তার মানে অন্য কোথাও গড়ে উঠেছে আর এক সংসার, আর এক রকমের যাপন। সেই যাপন কি শিকড়ে পায় জীবনের রস! এ-প্রশ্ন আকস্মিক নয়। বরং তা প্রসারিত ও সর্বস্ব হয়ে উঠলে ওই স্মৃতির কাছেই ফিরতে হয় কবিকে,
স্মৃতির জটলা, মানে জঙ্গল পাথর ঝরনাজল
কাশফুলে দোলা দেয় শেফালি-ঝরানো ছেলেবেলা-
কাঁচপোকা, শালতিডোঙা, ঝোপঝাড়, ঘুমন্ত পুকুর
পেতলের কলসি থেকে হতভম্ব হাতে জল পড়া-
এইসব।
বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির এই দ্রোহ পরিকল্পিত। কেননা তাই-ই আসলে ক্ষমতা আর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের ব্যক্তিগত যুদ্ধ সূচিত করে। কবি তো কবিতাতেই সমর্পিত। স্লোগান লেখার দায় তাঁর নয়। তবে রাজনীতি যে প্রসারিত অর্থে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের সন্ধান করে, তা কবিকে আন্দোলিত না করে পারে না। শক্তির কবিতার ভিতরও তাই অবধারিত এসে বসে মানুষ। তবে, সে মানুষ দুরকম। একরকম মানুষ যে মেনে নিয়েছে বা নিতে বাধ্য হয়েছে ‘অবিচার’। মৃত্যু আছে বলে শুধু মেনে নিয়েছে বেঁচে থাকাকে। যার দরুন ‘জড় ও জীবন্মৃত যমজের অভ্যুত্থান’। আর এক মানুষ, যে এই মেনে নেওয়ার বিরুদ্ধে অভিমানে মুখর। সমস্ত নাড়ি-ছেঁড়া যন্ত্রণা ধারণ করে যিনি একা একা গুমরে উঠছেন, কখনও বা রেগে উঠছেন। কিংবা শ্লেষে বলে উঠছেন,
ভালো কি মানুষ চায়? ভালো চায় কাঠ ও পাথর।
অনেক পাথর আছে নদীতীরে, ঝর্ণার নিকটে-
জানে কার কাছে থাকলে সুখে ও শান্তিতে থাকা হতো,
থাকা হয়, সবই জানে, মানুষের মতো নয় ওরা।
মানুষের মতো হলে ওরা যেতো সংবাদপত্রের
ডেসকে, যেখানে পাতে লুচি পড়ে, নুন লঙ্কা পড়ে;
ভজন ভোজন হয়, শবদে শবদে বিয়া হয়!
অযথার্থ খেলা হয় যথারীতি ইডেন গার্ডেনে।
মানুষ, মানুষের কান্না আর মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আকুতি নিয়ে প্রায় বালকের অভিমানে যিনি ঘোরেন, তিনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। প্রকৃতি থেকে, বিশ্বসংসার থেকে ছিঁড়ে যাওয়ার নিয়তিতে মানুষ ক্রমশ গড়িয়ে গড়িয়ে যায় ক্লান্তিকর বেঁচে থাকার ঢালু পথ ধরে! নগরায়ণের নিয়তি মানুষকে স্মৃতিহীন করে। তাই বুঝি সেই উচ্ছিন্ন মানুষকে কেন্দ্রে রেখেই এগিয়ে এগিয়ে যায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। যে রবীন্দ্রনাথকে সমসময়ের কবিদের মধ্যে ‘আবহাওয়ার মতো মিশে’ থাকতে দেখেছিলেন শক্তি, তাঁর মতো করেই যেন তিনি মুখ ডুবিয়ে দিতে চান দেশের শিকড়ে। আর ফিরে ফিরে আসে গ্রামসমাজ। অথবা এই বিশ্বপ্রকৃতিই। রবীন্দ্রনাথের মতোই যেন তাই নিজের স্বদেশ সন্ধান করেন শক্তি-
… দুর্গাদালানের কোণে কোণে
পায়রার প্রচ্ছন্ন গান কান পেতে শোনে
পাঠশালার রোগা ছেলে। গন্ধ পাবে শহুরে পৌঁছুলে
ঘাস থেকে, মাটি থেকে, মানুষের ব্যবহার থেকে
স্বদেশের চেনা গন্ধ, অন্ধরূপ, সন্ন্যাস, সংস্কৃতি।
এই যে স্বদেশের সন্ধান শক্তির, তা ক্রমশ হাতছাড়া হয়ে যেতে থাকে জাগতিক ষড়যন্ত্রে। শঙ্খ ঘোষ এই শহরের রাখালকে চিহ্নিত করেই তাই বলেছিলেন, “… যে বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী, সেই বিশ্বের বিরুদ্ধে তখন জেগে উঠতে থাকে একটা বালকোচিত অভিমান, সহ্য করতে না পারবার অভিমান। এই বিরূপতার সামনে এসে তার শূন্যতার ব্যাপ্তি দেখে তার ব্যাপক আঘাতে তখন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কেউ, কেউ হতে পারে আত্মঘাতী, আর কেউ-বা এর সামনে এসে দাঁড়াতে পারে- দাঁড়াতে চায়- আরেকটা কোনও প্রত্যাঘাত নিয়েই। কখনো সে প্রত্যাঘাতের অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায় রাগ বা বিদ্রুপ, কখনো নিবিড় কোনো বোধি, সমস্ত স্থূলাবরণ সরিয়ে সত্য আবিষ্কার করতে চায় যে বোধি, আর কখনো-বা এই সম্পর্কহারা ভালোবাসাহীন সময়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলা যায়, আর কিছু নয়, এই দেখো, শুধু, ভালোবাসাই আমার অস্ত্র। ছেলেটি বলতে চেয়েছিল সেইটুকুই, সেই ভালোবাসা দিয়েই শহরের অনড় বিন্যাসটাকে ভেঙে দিতে চেয়েছিল সে, কেন না ভালোবাসাই তার কাজ, কেননা ‘ভালোবাসা ছাড়া কোনো যোগ্যতাই নাই এ দীনের’। এটাই তার আত্মার ধর্ম, সেই ধর্ম থেকে বিচ্যুতির ভয়ে সে তাই ‘প্রাণপণে কলকাতাকে ভালোবাসার চেষ্টা করে চলেছে’। গ্রাম দিয়ে সে ভেঙে দিতে চেয়েছে শহর। যে-কোনো ছেলেরই কথা হতে পারে এটা, অথবা যে-কোনো মেয়ের। এটা হতে পারে নিরুপমের কথা, অথবা অবনীর, অথবা নন্দিনীর। আর নিশ্চিতভাবেই এটা হতে পারে শক্তির- শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের- সমস্ত কবিতাপ্রবাহের একবারে ভিতরকার কথা। গ্রাম দিয়ে তাঁর কবিতা ভেঙে দিতে চেয়েছিল শহর, প্রাণ দিয়ে তা ভেঙে দিতে চেয়েছিল মৃত্যু। বাল্য দিয়ে, বালকবয়স দিয়ে, তা ভেঙে দিতে চেয়েছিল বুড়ো-হয়ে-যাওয়া জীবন।’
আমরা বুঝতে পারি ‘শহর’ আর ‘গ্রাম’ এখানে মানুষের জীবনের দু-রকমের নিয়তি হয়ে উঠছে। শক্তির কবিতা সেই কোলাহল ঠোকাঠুকি পেরিয়ে যেতে পৌঁছতে চাইছিল একান্ত স্বদেশে। সে খোঁজ একজনের, মানুষের আবার চিরকালের একজন মানুষেরও বটে। যে জানে, জানাতে পারে, ‘স্বদেশের অর্থ জানে নির্জন স্বদেশই।’
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাই আমাদের, আজকের মানুষের কাছে সেই স্বদেশভাবনা আর স্বদেশসন্ধানের শক্তি।