নিজে অধুনাবিস্মৃত এক নির্দেশক হওয়া সত্ত্বেও কীসের জোরে আজও বাংলা ছবির ইতিহাসে বেঁচে আছে তাঁর সাসপেন্স ছবিরা? মনে হয়, এর পেছনে নির্দেশক প্রেমেন্দ্র মিত্রের চলচ্চিত্রবোধের চাইতেও বড় ভূমিকা রয়ে গিয়েছিল ভয়কে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা ভূতের গল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্রের। মানুষকে ভয় পাওয়ানোও যে কথাসাহিত্যিকের এক মুনশিয়ানা, কাজটা মোটেও সহজ নয়, এবং আলাদা করে তার জন্যও যে করতে হয় সাধনা, তেমনই যেন বিশ্বাস ছিল তাঁর। প্রেমেন্দ্র মিত্রকে নিয়ে লিখলেন আবেশ কুমার দাস।
আটলান্টিকের দু’ পারেই সমান জনপ্রিয় হয়েছিলেন স্যার অ্যালফ্রেড হিচকক। স্রেফ সাসপেন্স বা থ্রিলার ছবির সূত্রেই। প্রথম পর্বের ‘দ্য লজার: আ স্টোরি অফ দ্য লন্ডন ফগ’ (১৯২৭), ‘সিক্রেট এজেন্ট’ (১৯৩৬) বা ‘দ্য লেডি ভ্যানিশেজ’-এর (১৯৩৮) মতো ব্রিটিশ ছবি স্বদেশে এতটাই সাফল্য দেয় তাঁকে, যে, ‘রেবেকা’-র (১৯৪০) মারফত মার্কিন মুলুকে পাড়ি জমাতেও আর ভাবেননি তারপর।
পশ্চিম থেকে চোখ ফেরানো যাক নিজের ঘরে। দেখা যাবে, যে মানুষটির সূত্রে বাংলা ছবির প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া, সেই সত্যজিৎ রায় ‘চিড়িয়াখানা’-র (১৯৬৭) আগে এ জাতের ছবির ব্যাপারে সেভাবে চিন্তাভাবনা করেননি। এবং ঘটনা হল, ওই ছবির নির্দেশনার দায়িত্বও স্রেফ ঘটনাচক্রেই এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪) বা ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৯) তখন বহুদূর। বরং ১৯৬৫-র আগে ফেলুদার সাহিত্যগত অস্তিত্ব বলতেও কিছু ছিল না। যাক, এর আগে বাংলার প্রেক্ষাগৃহগুলিতে রমরমিয়ে চলা অগ্রদূতের ‘সবার উপরে’ (১৯৫৫) বা মঙ্গল চক্রবর্তীর ‘সোনার হরিণ’-কে (১৯৫৯) খানিকটা রহস্যনির্ভর বলা গেলেও সেই অর্থে সাসপেন্সধর্মী বলা যায় না কিছুতেই।
টলিপাড়া থেকে খানিক ঘুরে আসব আজকের বইপাড়ায়। দেখা যাবে, থ্রিলার আর ভয়ের যুগলবন্দিতেই অনেকটা বেঁচে আছে হালের কলেজ স্ট্রিট। বিশুদ্ধতাবাদীদের খুশি হওয়ার কথাই নয়। কিন্তু এটাই সত্যি। ভাবতে অবাকই লাগে, এই সময়ে দাঁড়িয়ে কী করে ভুলে গেলাম আমরা বাংলা রুপোলি পর্দায় তাঁর অবদানকে! না, মানুষটার নাম মোটেও বিস্মৃত হয়নি বাঙালি। কিন্তু তার নিজের ভাষার ছবিতে সফলভাবে সাসপেন্স-সংসর্গ ঘটানোর ভগীরথটি কে, সেই প্রশ্নের মুখে আজ খানিক হতচকিত হতে হয় বই-কি। হাল প্রজন্মের কথা বাদই দিলাম। একটু পুরনো মানুষদেরও অনেকেই ভুলে গেছেন বাংলা ছবিতে তাঁর অবদান।
মানুষটি প্রেমেন্দ্র মিত্র।
কবি, কথাসাহিত্যিক, কল্পবিজ্ঞান লেখক ও সর্বোপরি ঘনাদার স্রষ্টা হিসেবে যতটা মনে রেখেছি তাঁকে আমরা, সেই তুলনায় অনেকাংশেই বিস্মৃত তাঁর চলচ্চিত্র নির্দেশকের সত্তাটি। খুব উঁচুদরের নির্দেশক হয়তো ছিলেন না। টলিপাড়ায় পা রাখা প্রায় চল্লিশ ছুঁইছুঁই বয়সে (জন্ম সেপ্টেম্বর ৪, ১৯০৪)। কিন্তু একটা কারণে বাংলা রুপোলি পর্দা বরাবর ঋণী হয়েই থাকবে তাঁর কাছে। প্রথম বাংলা সাসপেন্স ছবি নির্দেশনার কৃতিত্ব তাঁরই। ছবির নাম ‘কালোছায়া’ (১৯৪৮)। চেষ্টা করলে আজও দেখা সম্ভব সে ছবি। উপরন্তু আর-একটা সূত্রেও বাংলা রুপোলি পর্দার ইতিহাসে উল্লেখ্য হয়ে থাকবে যুগপৎ এ ছবি ও নির্দেশকের নাম। অভিনেতা ধীরাজ ভট্টাচার্যকে দ্বৈত ভূমিকায় ব্যবহারের মারফত বিজ্ঞানের ছাত্র প্রেমেন্দ্র মিত্রই প্রথম বাংলা ছবিতে প্রবর্তন করেন উক্ত প্রকৌশলের। এবং, পরবর্তী প্রায় এক যুগের উপর্যুপরি চেষ্টায় বাংলা ছবিকে চুপিচুপি করেও তুলেছিলেন সাসপেন্স ঘরানায় দস্তুরমতো সাবালকও। তাও শিশির মিত্র, বিপিন মুখোপাধ্যায়, প্রবীরকুমার, বীরেন মিত্র, রবীন মজুমদার বা গৌতম মুখোপাধ্যায়দের মতো অধুনাবিস্মৃত অভিনেতাদের সাহায্যে। জীবনের শেষ ছবিতে যদিও তরুণকুমারের কাছ থেকে সম্ভবত জীবনের শ্রেষ্ঠতম অভিনয় আদায় করে নিতে পেরেছিলেন প্রেমেনবাবু। আর তাই, নরেশ মিত্রর ‘কঙ্কাল’ (১৯৫০) বা অজয় করের ‘জিঘাংসা’-কে (১৯৫১) মাথায় রেখেও বলতেই হয়, ‘চুপি চুপি আসে’-ই (১৯৬০) বাংলা রুপোলি পর্দার ইতিহাসে নির্মিত সেই প্রথম ছবি, যেখানে অপরাধের নেপথ্যে রয়ে যাওয়া মনোবিকলন তথা হিচককতুল্য ট্রিটমেন্ট অনবদ্য ভঙ্গিমায় ফুটে উঠেছিল পর্দায়। এই একটি বিষয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রকে বাংলা রুপোলি পর্দার ইতিহাসে, এমনকি সত্যজিৎ রায়েরও পথিকৃৎ মেনে নিতেই হবে।
আগাথা ক্রিস্টির ‘দ্য মাউসট্র্যাপ’-এর ছায়ায় নির্মিত ‘চুপি চুপি আসে’ প্রেমেন্দ্র মিত্রের হাতে কেবল বাঙালিয়ানায় ঋদ্ধই হয়নি, নান্দনিকতার মাপকাঠিতে সমকালীন বিশ্বের রহস্যধর্মী চলচ্চিত্রের প্রবণতাকেও অনুসরণ করে ফেলেছে দিব্যি। একই বছরে মুক্তি পাওয়া হিচককের ‘সাইকো’-র নরম্যান বেটের অপরাধপ্রবণতার নেপথ্য হেতুকে, চাঁপাখোলা অনাথ আশ্রমের সেই তিন দুর্ভাগা সহোদরের জ্যেষ্ঠ পানুর প্রতিশোধস্পৃহার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই মিলে যায় অঙ্কটা। দুজনের কাউকেই পুরোপুরি উন্মাদ বলা না গেলেও, স্বাভাবিক মানুষের সহজাত মানসিক স্থিতিও ছিল না কারোরই। এবং সেটাই ছিল তাদের অপরাধপ্রবণতার উৎসমুখ।
ফিরে যাওয়া যাক পেছনে। এই ধরনের তিনটে ছবি সারা জীবনে নির্মাণ করেছিলেন প্রেমেনবাবু। ‘কালোছায়া’ আর ‘চুপি চুপি আসে’-র মধ্যবর্তী পর্যায়ে ‘হানাবাড়ি’ (১৯৫২)। অল্প কথায় দেখে নেওয়া যায় ছবি তিনটের সংক্ষিপ্তসার।
বিশ বছর আগে প্রয়াত যজ্ঞেশ্বর ঘোষচৌধুরীর করে যাওয়া ইচ্ছাপত্রকে কেন্দ্র করে রুপোলি পর্দায় ঘনিয়ে ওঠে ‘কালোছায়া’। জ্যেষ্ঠপুত্র দীননাথ ও মধ্যম পীতাম্বরকে ত্যাজ্য করে কনিষ্ঠ রাজীবলোচনকেই নিজের একমাত্র উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গিয়েছেন যজ্ঞেশ্বর— এমনই ছিল জনশ্রুতি। সত্যই কি তাই? ঘটনাচক্রে সুখচরে এসে পড়তে হবে কলকাতার প্রখ্যাত গোয়েন্দা সুরজিৎ রায়কে।
শহর কলকাতা থেকে পাঁচ মাইল দূরে দক্ষিণ শহরতলির এক পরিত্যক্ত তেমহলা বাড়ি ও তার আশপাশে রাতবিরেতে দেখা যাওয়া এক গরিলার মতো জানোয়ারকে ঘিরেই দানা বেঁধে ওঠে ‘হানাবাড়ি’-র রহস্য। একে একে এসে পড়ে শিল্পী শ্রীমন্ত, কেন্দ্রীয় চরিত্র জয়ন্ত, তার পুরনো বাগদত্তা ললিতা আর এক রহস্যময় পাগলের মতো ছবির সব কুশীলবেরা। কোনান ডয়েলের ‘হাউন্ড অফ দ্য বাস্কারভিল’-এর ছায়া খুব অস্পষ্ট নয় এ ছবিতে। যদিও প্রেমেন্দ্র মিত্রের স্বরচিত উপন্যাস ‘হানাবাড়ি’ থেকেই তোলা হয়েছিল এ ছবি।
কলকাতার গিরিমাঝি লেনে এক ঝড়জলের সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া এক হত্যাকাণ্ডের অতীত সূত্র জুড়ে যায় চাঁপাখোলা অনাথ আশ্রমের এক দুর্ভাগ্যজনক পুরনো ঘটনার সঙ্গে। হত্যাকারীর অনবধানে ফেলে যাওয়া চিরকুট থেকে জানা যায় তার পরবর্তী গন্তব্য হতে চলেছে দূর মফস্সলের এক স্বাস্থ্যনিবাস। দর্শককে এরপর গিয়ে পড়তে হয় সেখানে। এবং, দেখা যায় আচমকা প্রাকৃতিক দুর্যোগে দ্বীপের মতো জেগে থাকা সেই একলা বাড়িতে চরিত্রেরা কার্যত জলবন্দি। হন্তারক ওই কজনের মধ্যেই উপস্থিত। সংক্ষেপে এই হল ‘চুপি চুপি আসে’-র পটভূমি।
প্রসঙ্গত, এ ছবিই ছিল নির্দেশক হিসেবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের জীবনের শেষ কাজ। কথায় বলে, ওস্তাদের মার শেষ রাতে। জীবনের শেষ ছবিতে সাসপেন্স ঘরানাকে বাংলা রুপোলি পর্দায় রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গিয়েছিলেন প্রেমেনবাবু।
প্রশ্ন হল, নিজে অধুনাবিস্মৃত এক নির্দেশক হওয়া সত্ত্বেও কীসের জোরে আজও বাংলা ছবির ইতিহাসে বেঁচে আছে তাঁর সাসপেন্স ছবিরা? বা নিদেনপক্ষে একটিও ছবি? মনে রাখতে হবে, তাঁর অপরাপর সামাজিক ছবিদের প্রায় ভুলেই গেছি আমরা। যাক, যে প্রশ্নটা উঠে এল এইমাত্র, খোঁজা যাক তার উত্তরই। মনে হয়, এর পেছনে নির্দেশক প্রেমেন্দ্র মিত্রের চলচ্চিত্রবোধের চাইতেও বড় ভূমিকা রয়ে গিয়েছিল ভয়কে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা ভূতের গল্পকার প্রেমেনবাবুর চিন্তা চেতনার। মানুষকে ভয় পাওয়ানোও যে কথাসাহিত্যিকের এক মুনশিয়ানা, কাজটা মোটেও সহজ নয়, এবং আলাদা করে তার জন্যও যে করতে হয় সাধনা, মনে হয় তেমনই বিশ্বাস ছিল তাঁর। তাই তো আটের দশকে ভৌতিক অমনিবাসের ভূমিকায় তিনি লেখেন, “…জীবনের নানা সময়ে লেখা যে ক-টি ভূতের গল্প আছে সেগুলির মধ্যে প্রথম যেটি লিখি সেটি রচনার পেছনে কী ভাবনা কাজ করেছিল তা এখানে বোধহয় একটু বলা যায়। গল্পটির নাম ‘কলকাতার গলিতে’। আর আমার ভূতের গল্প লেখার পেছনের ভাবনা কোন দিক দিয়ে যে একটু আলাদা তার ইঙ্গিতও গল্পটির মধ্যেই আছে। আঁদাড়ে পাঁদাড়ে শকুন-কাঁদা-শ্মশানে-মশানে-ভাগাড়ে নয়, এই মানুষ গিজগিজ কলকাতা শহরেই বুকের ভেতরটা হিম-করে-দেওয়া হাওয়ার ঝাপটা হঠাৎ লাগান যায় কি না তাই দেখাই ছিল আমার চেষ্টা।’’
আর তাই তাঁর বিভিন্ন ভৌতিক গল্পের চেনা অনুষঙ্গগুলো বারেবারে ফিরে আসে তাঁর সাসপেন্সধর্মী ছবির আনাচেকানাচে। এমনকি চরিত্রদের স্বভাবেও থেকে যায় ছায়া। ‘গল্পের শেষে’ কাহিনির সেই জলঝরা নসীপুরের এক পোড়োবাড়িতে একদঙ্গল ফুটবল-প্রিয় দামাল ছেলের আটকে পড়া যেভাবে মিলে যায় ‘চুপি চুপি আসে’-র পর্দায়। ‘হানাবাড়ি’-র নায়ক জয়ন্তর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় ‘কলকাতার গলিতে’ কাহিনির অবিনাশের ছায়া। বাঙালির অতি পরিচিত দাম্পত্য কলহের পটভূমি থেকেই যেভাবে নির্মিত হয়ে ওঠে ‘নিশাচর’ গল্পের ভিত্তি তাকেও বেশ খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁর ছবিতে।
সেই হিসেবেই মনে হয় সাসপেন্স ছবির নির্দেশক প্রেমেন্দ্র মিত্রকে ফিরে দেখা মানে আজ ভূত-শিকারি মেজোকর্তার জনককেও আরও বিশদে জানা।