মা দুর্গা ফিরে গিয়েছেন আপন গৃহে। রয়ে গিয়েছেন তাঁর কন্যা। দেবী দুর্গার পর পূজা লক্ষ্মী দেবীর। জানেন কি, এই দেবীকে নিয়ে একটি গান লিখেছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? কী সেই গান? সে-গানের খবর দিলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি যে ধর্মপরিচয়ে ব্রাহ্ম, সে কথা আমরা সকলেই জানি। বস্তুত, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরেই কলকাতায় ব্রাহ্ম ধর্ম প্রাথমিকভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। রাজা রামমোহন রায়ের আরব্ধ কাজ তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির উজ্জ্বল সন্তান, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোদ্দটি সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠতম রবীন্দ্রনাথও স্বভাবতই বাড়ির ব্রাহ্ম ভাবধারায় বড় হয়ে উঠেছিলেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপূজাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দেবেন্দ্রনাথের আমলে। ব্রাহ্মরা মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী নন, তাঁরা নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক। পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়েও উপাসনাগৃহ স্থাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই বিদ্যালয়েও কোনোরকম মূর্তিপূজার প্রচলন করা হয়নি। যদিও এ কথা বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ধর্ম নিয়ে গোঁড়ামি স্থান পায়নি কোনও কালেই। মানবধর্মকেই তিনি সব ধর্মের উপরে স্থান দিয়েছিলেন। সে কারণে হিন্দু ধর্মের প্রচলিত পূজার্চনা নিয়েও তিনি বিশেষ ভাবিত ছিলেন না।
আরও শুনুন: কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় ভুলেও এই কাজগুলো করবেন না, দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়বে না
এহেন রবীন্দ্রনাথ কি হিন্দু দেবদেবীকে কেন্দ্র করে কোনও গান লিখেছিলেন কখনও? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যায়, ‘মধুর মধুর ধ্বনি বাজে’ গানটির অবলম্বন দেবী সরস্বতী। অবশ্য সেই দেবী নিছক প্রতিমা নন। তিনি সৃষ্টির দেবী, সৌন্দর্যের দেবী, তিনি শ্রী-স্বরূপা। কিন্তু আরও সন্ধান চালালে দেখা যায়, অন্য বোনকেও বঞ্চিত করেননি কবিগুরু। তাঁর একটি গানের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন লক্ষ্মী দেবী। আরও আশ্চর্যের কথা, এ গানে আপাত ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে কোজাগরী পূর্ণিমারই আলো।
আরও শুনুন: কেবল ধনসম্পদের দেবী নন, বাংলায় শস্যের দেবী রূপেও এককালে পূজা পেতেন লক্ষ্মী
কী সেই গান?
রবীন্দ্রনাথ লিখছেন–
গভীর রাতে ভক্তিভরে কে জাগে আজ, কে জাগে।
সপ্ত ভুবন আলো করে লক্ষ্মী আসেন, কে জাগে।
ষোলো কলায় পূর্ণ শশী, নিশার আঁধার গেছে খসি–
একলা ঘরের দুয়ার-’পরে কে জাগে আজ, কে জাগে।
কোজাগরী কথাটির উৎপত্তিই ‘কো জাগতী’ থেকে, অর্থাৎ কে জাগে। স্পষ্টতই গানে সেই আভাস রেখে গেলেন কবি। আর গানের শেষ চরণ দুটিতে যেন প্রকাশিত হয়েছে লক্ষ্মীর চঞ্চলা রূপটিই। নিমেষের অসতর্কতায় যিনি হারিয়ে যান, আর ধরা দেন না। কবি লিখেছেন–
আজ যদি রোস্ ঘুমে মগন চলে যাবে শুভলগন,
লক্ষ্মী এসে যাবেন স’রে– কে জাগে আজ কে জাগে।।
‘বসুধা’ মাসিক পত্রিকায় কার্তিক ১৩১২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের এই গান। কোনও অজ্ঞাত কারণে গানটিতে পরে আর সুরারোপ করেননি তিনি। তাই এই গানটির কোনও স্বরলিপিও পাওয়া যায় না। ফলে গানটি ক্রমশ বিস্মৃতির আড়ালেই চলে গিয়েছে। পাশাপাশি বিস্মৃতির আড়ালে যেতে বসেছে এ কথাও, যে, দেবী লক্ষ্মীকে কেন্দ্র করে গান লিখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।