কথায় কথায় লাগসই প্রবাদ আওড়ানো বাঙালির স্বভাব। আর সেইসব প্রবাদ প্রবচনের মধ্যে ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’, এই প্রবাদ কে না শুনেছে! কিন্তু এই প্রবাদের গৌরী সেনের কি কোনও অস্তিত্ব ছিল বাস্তবে?
অলংকরণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
পুরনো কলকাতার পাতায় পাতায় কত না প্রবাদ! আর প্রতিটি প্রবাদের পিছনে রয়েছে এক-একটি গল্প। যেসব গল্পের মধ্যে দিয়ে দেখা যায় সেকালের কলকাতার এক ঝলক। সেই কলকাতা যেমন বিচিত্র, তেমনই বিচিত্র তার মানুষজন। তাদের কীর্তিকলাপ থেকেই তাই জন্ম নিয়েছে একের পর এক প্রবাদ প্রবচন।
আরও শুনুন: ৫১টি টিকি সংগ্রহ করেছিলেন হুতোম প্যাঁচা, উপাধি পেলেন ‘টিকি কাটা জমিদার’
এখনও আমাদের মুখে মুখে ফেরে একটি প্রবাদ, “লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন”। কোনও উৎসব অনুষ্ঠান, বিশেষত ভাল কাজের ক্ষেত্রে যদি প্রচুর অর্থের প্রয়োজন পড়ে, তখনই ফিরে আসে এই পুরনো বাগধারা। বোঝানো হয় যে কোনও না কোনও ভাবে টাকার ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে। তা নাহয় হবে, কিন্তু এই প্রবাদের উৎস কী? আর এখানে গৌরী সেন নামে যে ব্যক্তিটি টাকা দেবেন বলে কথক স্থির নিশ্চিত, তিনিই বা কে? খামোখা তিনি যে কাউকে টাকা দিতে যাবেন কেন? এই প্রবাদ শুনলে মনের মধ্যে এমনই নানা প্রশ্ন জেগে ওঠে।
আরও শুনুন: প্রথম বাঙালি মহিলা হিসেবে লিখেছিলেন আত্মজীবনী, জানেন কে তিনি?
পুরনো কলকাতার ইতিহাস থেকে জানা যায়, গৌরী সেন বলে সত্যিই একজন লোক ছিলেন সেকালের কলকাতায়। পুরো নাম গৌরীকান্ত সেন। সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী ছিলেন তিনি। যদিও আদতে তিনি কলকাতার লোক ছিলেন না, ছিলেন হুগলির, মতান্তরে বহরমপুরের বাসিন্দা। ১৭৩২ সাল নাগাদ কলকাতায় এসে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন গৌরী সেন। সঙ্গে সঙ্গে দুই পার্টনার মিলে ব্যবসাও ফেঁদে বসেন। ব্যবসার অন্য শরিক ছিলেন বৈষ্ণবচরণ শেঠ। গৌরী সেনের বুদ্ধিতেই নাকি তিনি দস্তার ব্যবসায়ে বেশ লাভ করেন। সেই লভ্যাংশ পেয়ে গৌরী সেনের অবস্থাও অচিরেই ফুলেফেঁপে ওঠে। কিন্তু এই সম্পদ কেবল নিজের কুক্ষিগত করে রাখতে চাননি গৌরী সেন। পরিবর্তে যে কারও প্রয়োজন হলেই অকাতরে অর্থব্যয় করতেন তিনি। জনরব অনুযায়ী, একাধিক লোককে তিনি ঋণমুক্ত করেছিলেন। এমনকি দেনা শোধ করে অথবা জরিমানা দিয়ে কারাবাসের হাত থেকেও বাঁচিয়েছিলেন।
ধনের গৌরবে বড়লোক হন তো অনেকেই। কিন্তু মানুষের মনে থেকে যান তাঁরাই, যাঁরা বিত্তের মতো চিত্তের দিক দিয়েও ধনী। আর সেই কারণেই বাংলার প্রবাদের মধ্যে দিয়ে আজও বেঁচে আছেন গৌরী সেন।