চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজেদের প্রতিভার পরিচয় রেখে গিয়েছেন ঠাকুরবাড়ির দুই ভাই, গগন ও অবন ঠাকুর। দেশি বিদেশি ধাঁচে ছবি আঁকার পাশাপাশি কার্টুন আঁকার ক্ষেত্রেও বিশেষ দক্ষতা ছিল গগনেন্দ্রনাথের। এমনকি রবীন্দ্রনাথ কিংবা মহাত্মা গান্ধীর মতো মনীষীদের নিয়েও কার্টুন আঁকতে ছাড়েননি তিনি।
পুত্রশোক ভোলার জন্য ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ছেলে গগনেন্দ্রনাথ। ক্রমে সেই জগতেই নিজের পথ খুঁজে পেলেন তিনি। দেশি বিদেশি দুই ঢঙেই এঁকেছেন ছবি, কিউবিক আর্টের ধরন আত্মস্থ করেছিলেন বলে ‘ইন্ডিয়ান কিউবিস্ট’ আখ্যাও পেয়েছিলেন। কিন্তু এসবের বাইরেও একেবারে অন্য এক ধাঁচের ছবি আঁকতেন তিনি। আজকের দিনে যাকে আমরা বলি ক্যারিকেচার বা কার্টুন, তথা ব্যঙ্গচিত্র, সেকালে এমন একগুচ্ছ ছবি এঁকেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর তাঁর এই ব্যঙ্গচিত্রের আদলে ধরা পড়েছেন সেকালের সব নামীদামি মানুষেরা। নিজের কাকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মহাত্মা গান্ধী, কে নেই তাঁর আঁকা ব্যঙ্গচিত্রের তালিকায়! রবীন্দ্রনাথ আরামকেদারায় বসে আকাশে উড়ে যাচ্ছেন, হাওয়ায় উড়ছে তাঁর সাদা দাড়ি, এঁকেছেন এ ছবিও।
আরও শুনুন: প্ল্যানচেটের অভ্যাস ছিল রবীন্দ্রনাথের, মৃত্যুর পর নাকি প্ল্যানচেটে সাড়া দিয়েছিলেন নিজেও
গগন ঠাকুরের আঁকা ক্যারিকেচার-সিরিজ দেখলে বোঝা যায়, ভারী অন্য ধাঁচের রসবোধ ছিল তাঁর। আসলে তাঁকে প্রায়শই হাইকোর্টে জুরির কাজে অংশ নিতে হত। বিচারকার্যের নোট নেওয়ার জন্য হাতে থাকত খাতা-পেনসিল। বিচারকের হাতুড়ি ঠোকা, সওয়াল-জবাব, উকিলের আনাগোনা, এ সবকিছুর মধ্যেই দেখা যেত, মাথা নিচু করে মন দিয়ে নোট নিচ্ছেন গগনেন্দ্রনাথ। আদতে সে সময়ে পোর্ট্রেট আঁকতেন তিনি। সামনে দেখা মানুষদের সরাসরি না এঁকে অন্যভাবে সাদা পাতায় ফুটিয়ে তুলতেন। উকিল, বিচারক, শ্রোতাদের চেহারার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসত বিভিন্ন চরিত্র। পরে ‘অদ্ভুত লোক’, ‘বিরূপ বজ্র’ আর ‘নব হুল্লোড়’ নামে ব্যঙ্গচিত্রের তিনখানা বইও প্রকাশ করেন তিনি।
আরও শুনুন: ঠাকুরবাড়িতে সবার ছোট, কেমন ছিল রবীন্দ্রনাথের ভাইফোঁটা?
কলকাতা লিগের মরশুমে বলা যাক গগন ঠাকুরের আঁকা এক চমৎকার কার্টুনের কথা। ১৯১১ সালে গোরা দলকে খালি পায়ে হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জিতে নিয়েছিল মোহনবাগান। পরাধীন দেশের ইতিহাসে সে বিজয় অন্য মাত্রা যোগ করেছিল। তার আগেই বাঙালিকে ফুটবল চিনিয়েছেন নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী। আর মোহনবাগানের শিল্ড জয়ের পরে ফুটবল উন্মাদনা আর জাতীয়তাবোধ যেন সমার্থক হয়ে দাঁড়াল। হয়তো সেই উন্মাদনার ছোঁয়া লেগেছিল বলেই একদিন মোহনবাগানের খেলা দেখতে ফুটবল মাঠে গিয়ে হাজির হলেন খোদ গগনেন্দ্রনাথ। এদিকে সেদিনই খেলার সময় শুরু হল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। যারা মাঠে নিয়মিত যায়, তাদের হাতে সেকালে ছাতা থাকতই। সে রোদ বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতেই হোক কি বিপক্ষের লোককে প্রয়োজন বুঝলে দু’ঘা কষাতে। কিন্তু গগন ঠাকুর তো একেবারেই সেই ফুটবলপাগল মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত আমজনতার মধ্যে পড়েন না। নিজের জুড়িগাড়ি থেকে নেমে ভিড় আর বৃষ্টির মধ্যে তিনি মাথা গলাতেও যাননি। কিন্তু বাইরে থেকেই তাঁর শিল্পীর চোখ নিজের প্রয়োজনীয় উপাদান ঠিক খুঁজে এনেছিল। বাড়ি ফিরে ‘মোহনবাগান’ নাম দিয়ে একটি কার্টুন আঁকলেন গগনেন্দ্রনাথ। পাতা জুড়ে, থুড়ি, মাঠ জুড়ে কেবল ছাতা আর ছাতা!
বুঝে নিন, সেকালের মোহনবাগানের খেলা দেখতে মাঠে ভিড় জমাত কতশত মানুষ!