অনির্বাণ অগ্নির লকলকে শিখার উত্তাপ নিয়ে, ছুঁয়ে দেখা যাবে দেবী জ্বালামুখীকে। এমনটাই বিশ্বাস ভক্তজনের। মহাভারতের পাণ্ডবরা, মুঘল সম্রাটরা ঘুরে গেছেন এ মন্দির। হিমাচলের পাহাড়ের গায়ে এ কেমন জ্যোতি-পীঠ?
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শক্তিপীঠের জন্মের কাহিনিটা মোটামুটি আমাদের জানা। আর-একবার সংক্ষেপে শুনে নেওয়া যাক। দক্ষযজ্ঞে অপমানিত হয়ে, পতির নিন্দা শুনে সতী করলেন দেহত্যাগ। ক্রুদ্ধ মহাদেব সতীর শীতল শব কাঁধে শুরু করলেন প্রলয়নাচন। এই বুঝি সবকিছু ধ্বংস হয় হয়। তখন বিষ্ণু আহ্বান করলেন তাঁর চক্রকে। সেই চক্র সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে। এক একটি খণ্ড যেখানে পড়েছে, সেখানেই গড়ে উঠেছে শক্তিপীঠ।
আরও শুনুন: দিওয়ালি সারা ভারতের আলোর উৎসব, কোথায় কেন পালিত হয় জানেন?
সতীর জিভ যেখানে পড়েছিল বলে কথিত আছে, সেখানে আদৌ কিন্তু কোনও জিভ নেই। আছে শুধু লকলকে অগ্নিশিখা। অনির্বাণ জ্যোতি। একটি নয়, সাত-সাতটি। সেই শিখার মাধ্যমেই যেন ছুঁয়ে দেখা সতী, অম্বিকা বা জ্বালামুখী মাতাকে। এমনটাই বিশ্বাস ভক্তের। জ্বালামখী মাতার শক্তিপীঠ, সতীর ৫১ পীঠের অন্যতম। ভারতের হিমাচল প্রদেশের কাংড়া উপত্যকায় অবস্থিত এই মন্দির।
আরও শুনুন: ধনতেরসে সোনা কেনার রীতির নেপথ্যে আছেন এক নারী? শুনে নিন সেই গল্প
পুরাণ মতে, বিষ্ণুর চক্রে খণ্ডবিখণ্ড সতীর পূত দেহের জিভটি নাকি পড়েছিল আজকের হিমাচল প্রদেশের কাংড়া অঞ্চলে। সেখানকার রাজা তখন ছিলেন ভূমিচাঁদ। একদিন রাতে তিনি স্বপ্নে এই উপত্যকায় মন্দির তৈরির নির্দেশ পান। তারপর এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। দেবী এখানে সিদ্ধিদা বা অম্বিকা রূপে পূজিতা। দেবীর জিভ এখানে পড়ার জন্য দেবী অনন্ত অগ্নিময় জ্যোতিরূপে এখানে ভক্তদের দর্শন দিয়ে থাকেন।
জনপ্রিয় কালীগানের কথা ধার করে বলতে হয়, – কত নামে কত জনে ডাকে যে তোমায় / দাও মা সাড়া। সেই সাড়া পেতেই এই মন্দিরে নামে ভক্তের ঢল। একটি নয় সাতটি অনির্বাণ জ্যোতি, দেবীর সাত রূপে এখানে পূজিতা। বিন্ধ্যবাসিনী, হিঙ্গলাজ মাতা, অন্নপূর্ণা, মহাকালী, মহালক্ষ্মী, মহাসরস্বতী, ও অম্বিকা। আর শিব এখানে রয়েছেন উন্মত্ত। কথিত আছে অনেক রাজাই নাকি অবিশ্বাস করে এই অখণ্ড জ্যোতি নেভানোর চেষ্টা করেছেন। অখণ্ড জ্যোতি ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য নিকটবর্তী ঝরনার জলকে আটকে রাখা হয়েছিল। সেই বাঁধ দেওয়া জলাশয় আজও রয়েছে এখানে, গৌরীকুণ্ড নামে। মন্দিরের দর্শনার্থীরা কুণ্ডটিও দেখতে যান। তবে এত কিছুর পরও অগ্নিশিখা অনির্বাণ থাকায় সকলেই নতমস্তকে ওই মন্দিরে, ওই জ্যোতির মাধ্যমে দেবী জ্বালামুখীর অস্তিত্ব মেনে নেন। এর পরই জ্বালামুখী দেবীর জন্য সোনার ছাতা গড়িয়ে দেন এক সম্রাট। কিন্তু দেবী তাঁর মনের দর্প আঁচ করতে পারেন। তৎক্ষণাৎ সেই সোনার ছাতা আগুনে পুড়ে যায়। পরে বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে বলেন, তাতে সোনার আর কোনও গুণই অবশিষ্ট নেই। অন্তরে ভক্তি না থাকলে দেবী যে কিছু গ্রহণ করেন না এবং তার করাল মূর্তি যে সব তছনছ করে দিতে পারে এটা তারই প্রমাণ।
পাহাড়ের গায়ে চারটি গম্বুজের উপর তৈরি অম্বিকার এই মন্দির। প্রায় ৬ হাজার বছর আগে নাকি পাণ্ডবরা তাদের বনবাসের সময় এটিকে ভগ্নপ্রায় অবস্থায় দেখে ভালোভাবে নির্মাণ করেন এর দেওয়াল ও ছাদ। এখন এর দেওয়াল শ্বেতপাথরের কারুকাজ করা আর চূড়া সোনার। ইতিহাস বলছে, মন্দিরের ওপরের সোনার অংশ রাজা রণজিৎ সিংহের দান। সম্রাট আকবরের প্রধানমন্ত্রী ও জীবনীলেখক, আবুল ফজলের আইন-ই -আকবরীতেও জ্বালামখীর পূর্ণ জ্যোতির উল্লেখ রয়েছে। তবে এই অনির্বাণ জ্যোতি বর্তমান বিশ্বের কাছেও রহস্যই। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর আত্মজীবনী ‘তুজকু-ই-জাহাঙ্গীরি’তে লিখেছেন – ‘পাহাড়ের ঢালু গায়ে গন্ধকের আকর আছে। তার উত্তাপে অগ্নিশিখার সৃষ্টি হয়। এবং অনবরত তা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলেছে।’ এই কথা কতটা সত্যি তা যাচাই করতে জ্বালামুখী অগ্নিকুণ্ডে একাধিকবার পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়েছে কিন্তু সকলেই বিফল হয়েছেন। সবশেষে তাই বলতে হয় – তিনিই নিত্যশক্তি। জীবনের আদি ও অন্ত তিনিই।