ভূত আছে কি নেই, এই নিয়ে দ্বন্দ্ব মেটেনি এখনও। তবে এই বিষয়ে নিশ্চিত হতেই অনেকে ভূতকে ডেকে আনার প্ল্যান করেন এই পৃথিবীতে। সেই প্ল্যানের নাম ‘প্ল্যানচেট’ বা ‘সিঁয়াসে’। বাংলায় বললে ‘প্রেতচক্র’। এই কাজে আগ্রহী ছিলেন অনেক রথী-মহারথী। কিন্তু জানেন কি, তাঁদের মধ্যে আছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও?
রায় পরিবারের তরফে শোনা যায়, সত্যজিৎ রায়ের শান্তিনিকেতনে কলাভবনে ভরতি হওয়ার মূলে নাকি ছিল রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট-এর অভ্যাস। কীরকম? একবার কবির আয়োজিত প্রেতচক্রে সাড়া দিয়েছিলেন নাকি আরেক কবি, সুকুমার রায়। মাত ৩৬ বছর বয়সেই যাঁর দেহান্ত হয়েছিল। তিনিই প্রেতচক্রে এসে ছেলে সত্যজিৎকে কলাভবনে ভরতি করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। আর সেই ইচ্ছেকে সম্মান দিয়েই প্রেসিডেন্সি কলেজের অর্থনীতি ক্লাসের বদলে সত্যজিতের গন্তব্য হয় কলাভবনে নন্দলাল বসু-বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়-রামকিঙ্কর বেজের শিক্ষাসত্র।
আরও শুনুন: পিয়ানো বাজান, ঘোড়াও চড়েন… কলকাতার পুরনো বাড়িতে এখনও নাকি দেখা মেলে ‘তেনাদের’
রবীন্দ্রনাথের জীবনে কিন্তু এ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পরলোকচর্চায় রীতিমতো আগ্রহ ছিল রবীন্দ্রনাথের। নিজের আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’-তে তিনি জানিয়েছিলেন তাঁর ছোটবেলার প্ল্যানচেট করার খবর। আর শেষ বয়সে সেই আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল কয়েক গুণ। উদ্যোগ নিয়ে একাধিকবার প্রেতচক্রের আয়োজন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেইসব চক্রে তাঁর অনেক মৃত প্রিয়জন সাড়া দিয়েছিলেন বলেও জানিয়েছেন সেখানে উপস্থিত মানুষেরা। এমনকি, আত্মাদের সঙ্গে কবির কথোপকথনকেও লিপিবদ্ধ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সচিব কবি অমিয় চক্রবর্তী এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৌহিত্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়। শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রসদনে ‘ভৌতিক প্রসঙ্গ’ শিরোনামে আটটি খাতা সংরক্ষণ করা হয়েছে, যেখানে ঠাঁই পেয়েছে জীবিত আর মৃত মানুষের সেই আলাপ। প্রেতচক্রে আসা আত্মাদের তালিকাও রয়েছে সেই খাতাগুলিতে। সেই তালিকা দেখলে অবাক হতে হয়। ওই বিবরণে দাবি করা হয়েছে, চক্রে সাড়া দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের একান্ত প্রিয়জনেরা, স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী, বড় মেয়ে মাধুরীলতা, দুই দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ও তাঁর স্ত্রী সাহানা প্রমুখ, সেই সময়ে যাঁরা সকলেই মৃত। সবচেয়ে বেশিবার নাকি সাড়া পাওয়া গিয়েছিল কবির সবচেয়ে প্রিয় সন্তান, এগারো বছর বয়সে মৃত শমীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের আয়োজিত প্রেতচক্রে পারিবারিক গণ্ডির বাইরেও একাধিক গুণীজনের সাড়া মিলেছিল বলে দাবি করা হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়, অবনীন্দ্রনাথের জামাই সাহিত্যিক মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, বন্ধু লোকেন পালিত ও মোহিতচন্দ্র সেন, এমন অনেকেই। শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মোহিতচন্দ্র সেনের মেয়ে উমা গুপ্ত ছিলেন এইসব প্রেতচক্রের মিডিয়াম।
আরও শুনুন: বিলেতে মৃত্যু বড়লাটের, তবে কীসের টানে আজও নেটিভ শহরে ঘোরে হেস্টিংসের ভূত?
আশ্চর্যের কথা হল, জীবিত অবস্থায় পরলোকচর্চা নিয়ে যাঁর এত আগ্রহ ছিল, মৃত্যুর পর তিনি নিজেও নাকি সাড়া দিয়েছিলেন প্রেতচক্রে। ‘পরলোকের বিচিত্র কাহিনী’ বইয়ে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ১৯৪৫ সালের ২৩শে ডিসেম্বর এক প্রেতচক্রে নাকি উপস্থিত হয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। নিজের শেষ দিনের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছিলেন, সৌরীন্দ্রমোহনের কলমে তার বিবরণও মেলে। কবি নাকি বলেছিলেন, “আমি যখন কলকাতায় দেহত্যাগ করলুম, তখন দেখলুম যে দেহ থেকে একটা সাদা কুয়াশা যেন বেরিয়ে এলো! দেহ এখনও শয্যার উপর পড়েই ছিল। সেই কুয়াশাটা ক্রমে আমার কাছে এল… আমি তার ভিতরে প্রবেশ করলুম।” আত্মীয় বন্ধুদের শোক প্রকাশ দেখে কী মনে হয়েছিল তাঁর? কবির কথায়, “তাদের জন্য আমার বড় দুঃখ হতে লাগলো… ভাবলুম, যাক… আবার দেহটার মধ্যে প্রবেশ করি। চেষ্টা করলুম… কিন্তু কিছুতেই তা হলো না। সে-সময় আমার চেহারা ছিল ধোঁয়ার আকার… যাকে বলে, সূক্ষ্ম শরীর। হাত-পা সবই তখন আমার ছিল… কিন্তু সবই ছিল ধোঁয়ার তৈরি। আমি আমার স্থূল দেহের ভিতর প্রবেশ করতে না পেরে বিরক্ত হয়ে উঠলুম। তখন পর্য্যন্ত আমি ঠিক বুঝতে পারিনি যে আমার মৃত্যু হয়েছে! আমি মনে করছি, স্থূল দেহ থেকে বেরিয়ে এসেছি… বাইরের একটু হাওয়া-বাতাস লাগিয়েই আবার দেহের মধ্যে ফিরে যাবো।”
রবীন্দ্রনাথ কি সত্যিই অশরীরীদের উপস্থিতি অনুভব করেছিলেন? তিনি নিজেই কি অশরীরী রূপে সাড়া দিয়েছিলেন প্রেতচক্রে? তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, থাকবেও। তবে সেই বিতর্কের উত্তরও তিনিই দিয়ে গিয়েছেন। বলেছেন, “যে বিষয়ে প্রমাণও করা যায় না, অপ্রমাণও করা যায় না, সে সম্বন্ধে মন খোলা রাখাই উচিত। যে কোন একদিকে ঝুঁকে পড়াটাই গোঁড়ামি।”