‘মা কি আমার কালো রে!/ কালো রূপ দিগম্বরী, হৃদপদ্ম করে আলো রে!’ – এ গান গাইতেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। একবার তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কালী কি কালো? আমরা তো সেভাবেই দেখি মা-কে। কিন্তু ঠাকুর কী উত্তর দিয়েছিলেন? আসুন শুনে নিই।
সেবার কেশব সেনের সঙ্গে নৌকাবিহার করছেন ঠাকুর। কথা হচ্ছে বিবিধ প্রসঙ্গে। বেদ ও তন্ত্রের সমন্বয় নিয়ে ঠাকুর তাঁর ভাবনাজগৎ মন্থন করে নানা কথা শোনাচ্ছেন। বলছেন, ব্রহ্মকে ছেড়ে শক্তিকে শক্তিকে ছেড়ে ব্রহ্মকে ভাবা যায় না। নিত্যকে ছেড়ে লীলা, লীলাকে ছেড়ে নিত্য ভাবা যায় না!’ … “আদ্যাশক্তি লীলাময়ী; সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। তাঁরই নাম কালী। কালীই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই কালী! একই বস্তু, যখন তিনি নিষ্ক্রিয় — সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় কোন কাজ করছেন না — এই কথা যখন ভাবি, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন তিনি এই সব কার্য করেন, তখন তাঁকে কালী বলি, শক্তি বলি। একই ব্যক্তি নাম-রূপভেদ।’
আরও শুনুন: গৃহস্থের তপস্যার উপায় নেই, কোন পথ বলে দিয়েছিলেন ঠাকুর ও শ্রীশ্রীমা সারদা?
এই শুনে কেশব সহাস্যে বললেন, কালী কতভাবে লীলা করছেন, সেই কথাগুলি বলুন। ঠাকুরও তা শুনে হাসলেন। তারপর বললেন, তিনি নানাভাবে লীলা করছেন। তিনিই মহাকালী, নিত্যকালী, শ্মশানকালী, রক্ষাকালী, শ্যামাকালী। মহাকালী, নিত্যকালীর কথা তন্ত্রে আছে। যখন সৃষ্টি হয় নাই; চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, পৃথিবী ছিল না; নিবিড় আঁধার; তখন কেবল মা নিরাকারা মহাকালী — মহাকালের সঙ্গে বিরাজ করছিলেন।
শ্যামাকালীর অনেকটা কোমল ভাব — বরাভয়দায়িনী। গৃহস্থবাড়িতে তাঁরই পূজা হয়। যখন মহামারী, দুর্ভিক্ষ, ভুমিকম্প, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি হয় — রক্ষাকালীর পূজা করতে হয়। শ্মশানকালীর সংহারমূর্তি। শব, শিবা, ডাকিনী, যোগিনী মধ্যে শ্মশানের উপর থাকেন। রুধিরদারা, গলায় মুণ্ডমালা, কটিতে নরহস্তের কোমরবন্ধ। যখন জগৎ নাশ হয়, মহাপ্রলয় হয়, তখন মা সৃষ্টির বীজ সকল কুড়িয়ে রাখেন।
আরও শুনুন: Spiritual: ঠাকুর বলতেন, কর্ম না করলে ঈশ্বরদর্শন হয় না…
এরপর ঠাকুর তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসিক বঙ্গিতে বললেন, গিন্নীর কছে যেমন একটা ন্যাতা-ক্যাতার হাঁড়ি থাকে, আর সেই হাঁড়িতে গিন্নী পাঁচরকম জিনিস তুলে রাখে। ঠাকুরের মুখে তত্ত্বকথার এমন সরল ব্যাখ্যা শুনে কেশব সেন আর বাকি সকলেই হাসতে লাগলেন। ঠাকুরও সেই হাসিতে যোগ দিলেন। আর বললেন, “হ্যাঁ গো! গিন্নীদের ওইরকম একটা হাঁড়ি থাকে। ভিতরে সমুদ্রের ফেনা, নীল বড়ি, ছোট-ছোট পুঁটলি বাঁধা শশাবিচি, কুমড়াবিচি, লাউবিচি — এই সব রাখে, দরকার হলে বার করে। মা ব্রহ্মময়ী সৃষ্টি-নাশের পর ওইরকম সব বীজ কুড়িয়ে রাখেন। সৃষ্টির পর আদ্যাশক্তি জগতের ভিতরেই থাকেন! জগৎপ্রসব করেন, আবার জগতের মধ্যে থাকেন। বেদে আছে ‘ঊর্ণনাভির’ কথা; মাকড়সা আর তার জাল। মাকড়সা ভিতর থেকে জাল বার করে, আবার নিজে সেই জালের উপর থাকে। ঈশ্বর জগতের আধার আধেয় দুই।
বাকি অংশ শুনে নিন।