প্লাস্টিকের বল, প্লাস্টিকের খেলনা, প্লাস্টিকের বোতল, এক কথায় আমাদের চারদিকে আজ প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসপত্রের ছড়াছড়ি। আর এই প্লাস্টিকের বাড়াবাড়িতে পরিবেশ দূষণ যে কোন মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে, সে কথাও আমাদের অজানা নয়। কিন্তু জানেন কি, এই প্লাস্টিক তৈরি হয়েছিল বলেই প্রকৃতি, থুড়ি, প্রকৃতির এক প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত হতে হতে বেঁচে গিয়েছিল? শুনে নেওয়া যাক সে গল্প।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল, প্লাস্টিক কথাটার ঠিকঠাক অর্থ হল নমনীয়, অর্থাৎ যাকে ইচ্ছেমতো আকার দেওয়া যায়। আমরা এককথায় যাদের প্লাস্টিক বলে দাগিয়ে দিই, তাদের আসল নাম পলিমার। সে যাই হোক, এই প্লাস্টিক ব্যাপারটা কিন্তু প্রকৃতি থেকে সরাসরি পাওয়া যায় না। মানুষই এর সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু কেন তৈরি হয়েছিল প্লাস্টিক? আর কোন প্রাণীকেই বা বাঁচিয়ে দিয়েছিল প্লাস্টিক? বলছি সে কথাই।
উনিশ শতকে অভিজাত বিলিতি পরিবারে বিলিয়ার্ড খেলার চল ছিল ভালরকম। খেলাধুলো তো ভাল কথাই, কিন্তু মুশকিল হল যে এই খেলার দৌলতে হাতির বংশ নির্বংশ হওয়ার জোগাড়। কেন? আসলে সেকালে দাবার ঘুঁটি বলুন, বিলিয়ার্ডের বল বলুন, খেলাধুলোর উপাদানের ক্ষেত্রেও কোনোরকম সস্তা জিনিস ব্যবহার করার অভ্যাস ছিল না অভিজাত কিংবা ধনী মানুষদের। তাতে ব্যবহৃত হত সোনার মতো কোনও দামি ধাতু, অথবা আরেকটি দামি প্রাণীজ বস্তু, হাতির দাঁত। বিলিয়ার্ড খেলার বল বানানো হত আইভরি, অর্থাৎ হাতির দাঁত দিয়েই। সুতরাং হাতি শিকার তো করতেই হবে, নইলে দাঁতের জোগান আসবে কোথা থেকে!
আরও শুনুন: জন্ম গ্রিস, মিশর না চিনে, কীভাবে রূপ পেল আজকের ছাতা?
এইভাবেই হয়তো হাতিরও নাম উঠে যেত বিলুপ্ত প্রাণীর তালিকায়। ভাগ্যিস, তার আগেই আসরে নামল প্লাস্টিক।
সে অবশ্য আরেকটু পরের কথা। তার আগেই একটা সময় এমন এসেছিল যে বাজারে আইভরি বল অমিল। হাতির সংখ্যা তখন এতটাই কমে এসেছে যে বলের জোগান দিয়ে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। ‘দ্য নিউইয়র্ক বিলিয়ার্ড কোম্পানি’ আর উপায় না দেখে বিজ্ঞাপন দিল, হাতির দাঁতের বিকল্প কোনও জিনিস চাই। যদি কেউ এমন কিছু আবিষ্কার করতে পারে, তবে মিলবে নগদ পুরস্কার। কড়কড়ে ১০০০০ ডলার।
বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ে গেল দুই ভাই জন ওয়েসলে হায়াত এবং ইসাইয়া হায়াত-এর। সিনিয়র হায়াত বিজ্ঞানী বা আবিষ্কারক কিছুই ছিলেন না, এক ছাপাখানার নেহাতই ছাপোষা কর্মচারী, কিন্তু গবেষণা করার উৎসাহ ছিল তাঁর। ঘটনাচক্রে তিনি তখন এই বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন। বিলিয়ার্ড কোম্পানির বিজ্ঞাপন সেই আগুনে আরেকটু ঘি ঢেলে দিল। কোমর বেঁধে কাজে নেমে পড়লেন হায়াত ভাইয়েরা।
বলা হয়, বিজ্ঞানের অধিকাংশ আবিষ্কারই ঘটেছে আকস্মিকভাবে। এখানেও প্রায় তাই হল। সিনিয়র হায়াতের হাত ফসকে একটা কলোডিওন ভর্তি বোতল একদিন মেঝেতে পড়ে গেল। কাচের বোতল ভেঙে চুরমার, তরল কলোডিওন মেঝেতে ছড়িয়ে একাকার। অবাক কাণ্ডটা ঘটল হায়াতের চোখের সামনেই। কয়েক মুহূর্ত পরেই জমাট বাঁধতে শুরু করল মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা কলোডিওন। তৈরি হল শক্ত, রবারের মতো একটা জিনিস। হায়াত দেখলেন এটা দিয়েই তো দিব্যি বল বানিয়ে ফেলা যায়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কিন্তু বলগুলো বিশেষ সুবিধের হল না। খেলতে গিয়ে বলে বলে ঠোকাঠুকি লাগবেই। আর অমনি বলগুলো কথা নেই বার্তা নেই, ভেঙে যেত।
আবার মাথা ঘামাতে শুরু করলেন হায়াত। ভেবেচিন্তে কলোডিওনের সঙ্গে কর্পূর মেশালেন তিনি। ব্যস, প্রবলেম সলভড। যা তৈরি হল, তাকে আজ আমরা চিনি ‘সেলুলয়েড’ বলে। আর হাতির দাঁতের এই বিকল্পকেই বলা যায় মানুষের তৈরি প্রথম ‘প্লাস্টিক’।