নয়ের দশকের নস্টালজিয়া ছিল বুড়িমার চকলেট বোম। কান ফাটানো আওয়াজের, ভয় ধরানো আলোর চকলেট বোমের প্যাকেটের উপর থাকত নিরিহ বুড়িমার ছবি। বুড়িমা, অর্থাৎ কিনা অন্নপূর্ণা দাস। বাঙালি নারী হিসেবে যিনি এক আশ্চর্য নজির গড়ে গেছেন। শূন্য থেকে শুরু করা সফল বাঙালি উদ্যোগপতিদের কথা হলে, তাঁর কথাও ওঠা উচতি নয় কি?
বাঙালি উদ্যোগপতিদের নিয়ে গবেষণা হল তাঁর কথা উঠবে তো! ওঠা কিন্তু উচিত। আজকাল নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কত কথা হয়, হাতের কাছে উদাহরণ ছিলেন তিনি। তবে তাঁকে আধুনিকা বলা যাবে না। এককালে বাঙালির ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর যে ছবি, তাতে মাথায় ঘোমটা টানা আইডিয়াল ‘বুড়িমা’ তিনি। বাংলার শব্দবাজির বাজারে যে বুড়িমা হয়ে গেল কিংবদন্তি। কালীপুজো মানেই ছিল বুড়িমা, হ্যাপি নিউ ইয়ার মানেও, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচেও হইহই করে ফাটত কান ফাটানো বুড়িমার চকলেট বোম। এইসঙ্গে বাঙালি মেয়ে হিসেবে অনন্য নজির গড়ে ফেললেন অন্নপূর্ণা দাস।
বুড়িমারই নাম অন্নপূর্ণা দাস। জন্ম বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়। কম বয়সে বিয়ে হয়। তিন মেয়ে ও এক ছেলের মা হন। ছেলেমেয়েরা ছোট থাকতেই মৃত্যু হয় স্বামী সুরেন্দ্রনাথ দাসের। দেশভাগের পর সন্তানদের নিয়ে পূর্বতন পশ্চিম দিনাজপুর জেলার ধলদিঘির সরকারি ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। পেট চালাতে ধলদিঘির বাজারে সবজি বেচে সন্তানদের মুখে অন্ন তুলে দিতেন অন্নপূর্ণা।
আরও শুনুন: আগুন লাগলে খবর যায় ফায়ার সার্ভিসে, তার নাম ‘দমকল’ কীভাবে হল জানেন?
কঠিন জীবনের লড়াই সামলাতে একসময় ধলদিঘি থেকে গঙ্গারামপুরে চলে যান অন্নপূর্ণা দাস। এই সময় বিড়ি বাঁধার কাজও করতেন। কিছুদিন পর নিজেই বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা জমে যায়। ছোটখাটো একটা বিড়ির কারখানা হয়। এই পর্বে মেয়ের বিয়ে দেন বেলুড়ে। সেই সূত্রে নিজেও চলে আসেন বেলুড়ে। বেলুড়ের প্যারিমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে একটা দোকান-সহ বাড়ি কিনে ফেলেন। স্থায়ী ঠিকানা হওয়ার পর বুদ্ধিমান উদ্যোগপতির মতো ব্যবসা বাড়ান অন্নপূর্ণা। বিড়ির সঙ্গে আলতা ও সিঁদুরের ব্যবসা করেন। এখানেই থেমে না থেকে বিশ্বকর্মা পুজোর সময় ঘুড়ি, দোলে রং এবং কালীপুজোয় বাজির ব্যবসাও শুরু করেন। তবে তখনও নিজে তৈরি করতেন না, মহাজনের কাছ থেকে মাল কিনে বিক্রি করতেন।
ততদিনে অন্নপূর্ণা দাসের বয়স হয়েছে। স্থানীয় দোকানি থেকে সাধারণ ক্রেতারা তাঁকে ‘বুড়িমা’ সম্বোধন করে। এই ‘বুড়িমা’ শব্দটাকেই বাজির ব্যবসার ব্র্যান্ডিং-এ কাজে লাগালেন অন্নপূর্ণা। নানারকম বাজি তৈরি করে বিক্রি করা শুরু করলেন। তবে বিখ্যাত হল ‘বুড়িমার চকলেট বোম’।
আরও শুনুন: রবি ঠাকুরের গানে উঠে এল দেবী লক্ষ্মীর কথা, জানেন কী সেই গান?
বুড়িমা ছিল নয়ের দশকের নস্টালজিয়া। ১৯৯৬ সালে সরকারিভাবে সেই নস্টালজিয়া গত হয়। কারণ ওই বছরেই ৯০ ডেসিবেল ও তার বেশি যাবতীয় শব্দবাজি নিষিদ্ধ হয়। বুড়িমা ব্র্যান্ডের ব্যবসা অবশ্য তাতে মার খায়নি। পরবর্তী প্রজন্ম আলোর বাজির ব্যবসা করছেন ঝকমকিয়ে। তবে চকলেট বোম জিনিসটা ওই বছরেই উঠে যায়। এই দিন অবশ্য দেখতে হয়নি বুড়িমাকে।
কারণ ১৯৯৫ সালে প্রয়াত হন অন্নপূর্ণা দাস। শব্দ ও আলোর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, রেখে যান এক অনন্য নজির। তবু বাঙালি উদ্যোগপতিদের নিয়ে গবেষণা হল তাঁর কথা উঠবে তো! তিনি তো আধুনিকা নন। আজকাল নারীর ক্ষমতায়ন নিয়েও কত কথা হয়, হাতের কাছে উদাহরণ ছিলেন তিনি।