সম্প্রতি এক খ্যাতনামা সাহিত্যপত্রিকার বিজ্ঞাপন নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে পাঠকমহলে। আপত্তির কারণ বিজ্ঞাপনটির ভাষা। যেখানে নারীকে রীতিমতো পণ্য করে তোলা হয়েছে বলেই মত পাঠকদের একাংশের। অবশ্য সাহিত্যের দুনিয়ায় এই প্রবণতা চলে আসছে বটতলার আমল থেকেই। আলোকপাত করলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়। অলংকরণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বটতলা বলতে বোঝানো হয় কলকাতা শহরের সেই জায়গাটিকে, যেখান থেকে বাংলার প্রকাশনা শিল্পের সূত্রপাত। উনিশ শতকে শোভাবাজার-চিৎপুর এলাকায় গড়ে ওঠা এই অঞ্চলের লক্ষ্য ছিল মূলত তুলনামূলক কম শিক্ষিত, সাধারণ মানের পাঠকের চাহিদা মেটানো। আর সেই ব্যবসায়িক দিকেই লক্ষ্য রেখে বটতলা থেকে বেরোত কেচ্ছাকাহিনির রগরগে গল্প। এমনকি অনেক সময় তখনকার নামী ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক কেলেঙ্কারি অবলম্বন করে লেখা হত সেসব বই। সঙ্গে যোগ্য সংগত করত বইয়ের বিজ্ঞাপন এবং প্রচ্ছদ, যেখানে থাকত অপটু হাতে আঁকা অর্ধউন্মুক্ত নারীশরীরের লোভনীয় আহ্বান।
আরও শুনুন: নারীপ্রগতির মশাল জ্বালিয়ে চলে গেলেন কমলা ভাসিন
আজকের দিনে বটতলার বই বলতেই সাধারণভাবে মনে করা হয় নিম্নরুচির বই। অথচ চারদিকে সামান্য খেয়াল করলেই প্রশ্ন জাগে, সেই রুচি কি এখনও উন্নত হয়েছে আদৌ? তাহলে দুশো বছর পেরিয়েও কেন প্রতিটি বিজ্ঞাপনে নারীশরীরকে আরও, আরও বেশি উন্মুক্ত করার প্রতিযোগিতা চলে? ভিজুয়াল মাধ্যমে তো বটেই, প্রিন্ট মাধ্যমে শব্দ-অক্ষর দিয়েও জারি রয়েছে এই প্রয়াস। সে কথাই আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সাম্প্রতিক বিজ্ঞাপনটি।
আরও শুনুন: ৪২ লিটার স্তনদুগ্ধ দান হাসপাতালে, ছকভাঙা কাজে কুর্নিশ আদায় করলেন ভারতীয় মহিলা
সদ্য প্রয়াত হয়েছেন এক বরিষ্ঠ সাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যের পাঠকমহলে রীতিমতো সমাদৃত ছিল তাঁর লেখা। অথচ বিজ্ঞাপনটিতে তাঁর সাহিত্যকীর্তি অথবা অন্যান্য গুণের বদলে ইঙ্গিত করা হয়েছে তাঁর বহুগামিতার দিকে। আর সেই প্রসঙ্গেই বিজ্ঞাপন জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে নারীশরীরের কাব্যিক বর্ণনা। উনিশ শতকে যে বিজ্ঞাপন বেরোত স্থূল, স্পষ্ট ভাষায়, তার উপর চাপানো হয়েছে রম্য গদ্যের মোড়ক। কিন্তু ভেতরের উপাদানে ফারাক কই! দুশো বছরের আগে পরেও যদি বাণিজ্যকে একইভাবে উপভোক্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়, তাহলে প্রশ্ন জাগে, মানুষের আদিম প্রবৃত্তিতে আদতে কতখানি বদল আনতে পেরেছে সভ্যতা কিংবা আধুনিকতা? গবেষণাপত্র, আলোচনাসভা, বিতর্কের আসরে নারীর পণ্যায়ন, টিআরপি, লিঙ্গরাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে কথা হয় যথেষ্ট। তারপরেও, যে সকল পুরুষ একাধিক নারীকে চারণ করতে সক্ষম, সমাজে তাদেরই সাহসী অভিধা জোটে। এই যুক্তিতে সঙ্গীর প্রতি বিশ্বাসভঙ্গই হোক কি তাকে ব্যবহার করা, সবই একরকমভাবে যাথার্থ্য পেয়ে যায়। কায়েম হয়ে যায় এই সত্য যে, নারী আদতেই পণ্য। যাকে পণ রাখা যায়, যাকে অধিকার করা যায়, যাকে নিয়ে বাণিজ্যও করা চলে।
আসলে মানুষের যা কিছু প্রবণতা, যত গোপন চাহিদা, তার দিকে লোভের ইশারা ছুড়ে দেওয়াই বিজ্ঞাপনের কাজ। নারীশরীরকে ইঙ্গিত করা বিবিধ স্ল্যাং শব্দ যখন কলেজপড়ুয়া থেকে মধ্যবয়স্ক সুচাকুরের কথার সাধারণ লব্জ হয়ে ওঠে, বিজ্ঞাপনের আর দোষ কোথায়! যা বিকোবেই, বাজার তার পসরা সাজাবে না কেন! বাজারের উপর দায় চাপিয়ে দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের দিকে ফিরে তাকানোর সময় কি আসেনি এখনও?