প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, দেবী লক্ষ্মী সশরীরে এখানে বিরাজ করছেন। এবং, মুম্বই নগরীকে সমৃদ্ধ ও তাঁর কৃপাধন্য করে রেখেছেন। কয়েকটি দ্বীপের সমষ্টি থেকে সে আজ দেশের ফিনানশিয়াল ক্যাপিটল। বাণিজ্যনগরী মুম্বই শহর তৈরির সঙ্গে কি যোগ রয়েছে দেবী লক্ষ্মীর?
জল থেকে উঠে এল একটা আস্ত শহর। আর শহরের মাথায়, পাহাড়চূড়ায় যার বাস? তিনিও এলেন জল থেকেই।
পর্তুগিজ কন্যার সঙ্গে বিয়ের সূত্রে আরব সাগরের ৭টি দ্বীপের সমষ্টি বম্বে, বর্তমানের মুম্বই নগরী যৌতুক পান লর্ড দ্বিতীয় চার্লস। ১৬৬৮ সাল নাগাদ বার্ষিক ১০টি গিনির বিনিময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চল লিজ নেয়। ভারতের পশ্চিম উপকূলের এই দ্বীপ অঞ্চলকে তাদের ব্যবসার সামুদ্রিক কেন্দ্র বলে স্থির করে কোম্পানি। বম্বেকে প্রাকৃতিক বন্দর হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ধীরে ধীরে সাতটি দ্বীপকে জুড়তে শুরু করে তারা। এই দ্বীপগুলি হল- বম্বে, কোলাবা, লিটল কোলাবা, মাহিম, মাজগাঁও, পার্লে ও ওয়রলি। দ্বীপগুলির মধ্যবর্তী অঞ্চলে সমুদ্র বেশ অগভীর ছিল। তাই পাহাড়গুলি থেকে পাথর এনে তা দিয়ে সেইসব অগভীর অঞ্চল এবং জলাভূমি ভরাট করার চেষ্টা চলে। এর ফলে পাহাড়গুলিও নিচু হয়ে যায়। ১৬৮৬ সালে সুরাট থেকে মুম্বাইতে তাদের সদর দপ্তর সরিয়ে আনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
আরও শুনুন: লক্ষ্মীকে বিয়ে করার জন্য ধার করেছিলেন বিষ্ণু, তিরুপতি মন্দিরে সেই ঋণ শোধ করেন ভক্তরা
কোম্পানির কাজ যখন জোরকদমে শুরু হয়ে গেল, তখন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের দিকে জোর পড়ল। ১৭৮২ সালে গভর্নর উইলিয়াম হর্নবি শুরু করলেন একটি নতুন প্রকল্প। গভর্নরের নাম অনুসারে তার নাম হল হর্নবি ভেলার্দ প্রকল্প। কী সেই প্রকল্প? বম্বের সাতটি দ্বীপকে একটি গভীর প্রাকৃতিক বন্দর-সহ একটি একক দ্বীপে পরিণত করার প্রকল্প। কিন্তু, রামায়ণের আমল থেকে যে সমস্যা চলে আসছে, সমুদ্রের বুকে সেতু বাঁধতে গিয়ে ফের সেই সমস্যার মুখোমুখি হল কোম্পানি। মালাবার হিল ও ওয়রলি দ্বীপকে যুক্ত করতে গিয়ে দেখা গেল সমুদ্র মানুষের তৈরি শিকল পরতে নারাজ। যতই নৌকা ভরে ভরে পাথর এনে তারা ওয়রলি খাঁড়িতে জমা করতে থাকে, অশান্ত সমুদ্রে তলিয়ে যায় সেসব পাথর। সম্পূর্ণ তৈরি হওয়ার আগেই ধসে পড়ে বাঁধের আগল। পরপর দুবার। বন্দর কি তাহলে হবে না! চিন্তিত হয়ে পড়েন গভর্নর হর্নবি। আর এরপরই নাকি ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা।
আরও শুনুন: কেবল ধনসম্পদের দেবী নন, বাংলায় শস্যের দেবী রূপেও এককালে পূজা পেতেন লক্ষ্মী
এই প্রকল্পের মূল নির্মাতা ছিলেন এক ভারতীয়। তাঁর নাম রামজি শিবজি প্রভু। প্রকল্প যখন আক্ষরিক অর্থেই বিশ বাঁও জলে, এই সময় এক রাতে তিনি নাকি স্বপ্নাদেশ পান স্বয়ং দেবী মহালক্ষ্মীর। দেবী তাঁকে স্বপ্নে বলেন, ওয়রলি খাঁড়ির জলে তাঁদের পাথরের মূর্তিগুলি ডুবে আছে। ডাঙায় কোথাও কি তাঁদের জন্য একটু জায়গা হবে? অবাক কাণ্ড, নিজের দল এবং এলাকার মৎস্যজীবীদের সাহায্যে ওয়রলি খাঁড়িতে তল্লাশি চালিয়ে প্রভু সত্যিই তিন দেবীমূর্তির হদিশ পান। দেবী মহালক্ষ্মীর সঙ্গে উদ্ধার করা হয় দেবী মহাকালী ও মহা সরস্বতীর মূর্তিও। এরপর কোম্পানির তরফে গভর্নর হর্নবি পাহাড়চূড়ায় দেবীমন্দির তৈরির জন্য জমির ব্যবস্থা করেন এবং ১৭৮৫ সাল নাগাদ ওই তিন বিগ্রহ সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওয়রলি থেকে মালাবারের সংযোগকারী ব্রিজ ক্যান্ডি বানাতে এরপর আর কোনও বাধা আসেনি।
বলা যায়, দেবী মহালক্ষ্মীর মতোই মুম্বই নগরীকেও জল ছেঁচে বের করে আনা হয়েছিল। ১৬৬৮ সালে যখন কোম্পানি এই এলাকা হাতে পায়, তখন এর জমি ১৮ বর্গমাইলও ছিল না। আর এখন বাণিজ্যনগরী মুম্বইকে বলা হয় দেশের অর্থনৈতিক রাজধানী। এই নগরীকে সমৃদ্ধ করে রেখেছেন দেবী মহালক্ষ্মী। শক্তির উৎস দেবী মহাকালী তাঁর ভক্তদের রক্ষা করে চলেছেন, আর তাঁদের সঙ্গে জ্ঞানের উৎস হিসেবে রয়েছেন দেবী মহা সরস্বতী। চার হাতে বরাভয় মুদ্রা নিয়ে মুম্বই উপকূলে বিরাজ করছেন তাঁরা।