মা লক্ষ্মী নাকি ধনসম্পদের দেবী। তাই তাঁকে ধরে রাখার জন্য এত আয়োজন। কিন্তু জানেন কি, আদি বাংলায় লক্ষ্মীর ব্রত করা হত শস্যের কামনায়? আসুন, শুনে নেওয়া যাক লক্ষ্মী পূজার আদি কথা।
প্রাচীন বাংলায় ধনসম্পদ মানেই জমি, তথা শস্য। শিল্প-বাণিজ্যের তখনও তেমন বিস্তার ঘটেনি, কৃষিই সেখানে অর্থ উপার্জনের উৎস। সুতরাং লক্ষ্মী দেবীকে ধনদেবী বলে মনে করলে, তাঁর সঙ্গে শস্যের সম্পর্ক থাকাই স্বাভাবিক। কোন দেবতা কোন অঞ্চলে পূজিত হবেন, তা আসলে অনেকখানিই নির্ভর করে সেই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতের উপরে। আর সেই কারণেই, বাংলার দেবদেবীর সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে জুড়ে যেতে থাকে শস্যের রূপক।
আরও শুনুন: লক্ষ্মী দেবীকে কেন্দ্র করে গান লিখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, জানেন কী সেই গান?
পুরনো প্রবাদে শোনা যায়, দেবী তুষ্ট হলে দশমীতে নাকি বৃষ্টি হবে দু-ফোঁটা। কৃষিজীবী ভূমিতে বৃষ্টির চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর কী আছে! দুর্গাপূজার নবপত্রিকাও তো শস্যের প্রতীক। তেমনই মা দুর্গা বাপের বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার কদিন পরেই তাঁর যে মেয়েটি মামার বাড়িতে পূজা নিতে আসেন, তাঁর সঙ্গেও রয়েছে শস্যের নিবিড় যোগ। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ বইয়ে লিখেছেন, “আমাদের লোকধর্মে লক্ষ্মীর আর একটি পরিচয় আমরা জানি এবং তাঁহার পূজা বাঙালি সমাজে নারীদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। এই লক্ষ্মী কৃষি সমাজের মানস-কল্পনার সৃষ্টি, শস্য-প্রাচুর্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী।”
আরও শুনুন: কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় ভুলেও এই কাজগুলো করবেন না, দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়বে না
লক্ষ্মী দেবী যে শস্যের দেবী, ‘বাংলার ব্রত’ বইয়ে এ কথার প্রমাণ দিয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তিনি জানিয়েছেন, বাংলায় মূলত তিনটি লক্ষ্মীব্রত পালন করেন মেয়েরা। নজর করলে দেখা যায়, তিনটি পুজোর সময়কালই সাযুজ্য রেখেছে কৃষিকাজের সঙ্গে। ফাল্গুন মাসে বীজ বপনের আগে যে লক্ষ্মী পুজো পান, তিনি হরিতা দেবী, অর্থাৎ গাত্রবর্ণ সবুজ। তাঁর আরাধনা করে তবে ঘর থেকে বীজ বের করে মাঠে নিয়ে যাওয়া হয় বোনার জন্য। দ্বিতীয় লক্ষ্মীব্রত হয় আশ্বিনের কোজাগর পূর্ণিমায়, যখন মাঠে মাঠে দেখা দিয়েছে নতুন ফসল। এই লক্ষ্মী তাই হলুদ বরন, স্বর্ণলক্ষ্মী। আর তৃতীয় লক্ষ্মীব্রতটি হয় অঘ্রানে, যখন পাকা ধান ঘরে এসেছে। ইনি হলেন অরুণা লক্ষ্মী।
লক্ষ্মীপূজার আলপনা এবং উপকরণেও রয়েছে শস্যের রূপক। আলপনা আসলে মানুষের মনের কামনাকেই ফুটিয়ে তোলে। লক্ষ্মীপুজোর আলপনায় আঁকা হয় ধানের ছড়া। আবার পূজার উপকরণের মধ্যেও একটি অত্যাবশ্যক উপাদান নতুন ধানের শিষ। আরেকটি উপাদান হল কলাগাছের অংশ। কলাগাছের কাণ্ড দিয়ে তৈরি নৌকায় সাজিয়ে দেওয়া হয় চাল, ডাল, হরীতকী, হলুদ, কড়ি ইত্যাদি। আবার কোথাও কোথাও থাকে কলার বেড়। যেখানে কলাগাছের কাণ্ড দিয়ে বানানো হয় নটি চোঙ, তার মধ্যে রাখা হয় পঞ্চশস্য এবং নারকেল। এই সময়ে, যখন কৃষি আর আমাদের একমাত্র জীবিকা নয়, তখনও টিকে রয়েছে এই প্রথাগুলি। যেন ধরে আছে প্রাচীন কৃষিজীবী বাংলার শিকড়কেই।