এগারো মাইলের জঙ্গল পেরিয়ে এসে পড়ে বন নবগ্রাম স্বাস্থ্যকেন্দ্র। পথনির্দেশ অনুযায়ী আর কিছুদূর এগিয়েই ডানদিকে একটা সরু রাস্তা পড়বে। ওই রাস্তা ধরে সোজা গেলেই ওয়ারিশপুর। যেখানে সারাবছর জারি থাকে এক অকাল ‘তালনবমী’। এই তালনবমীর নৈবেদ্য অবশ্য বড়া কিংবা পিঠে-পরোটায় মাখামাখি নয়। বরং, শাঁস বাদ দিয়ে তালের অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গদের আঁকড়ে ধরা। সারাবছর।
লিখছেন সোহম দাস।
পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীমহলে ভালমতোই পরিচিত মদনমোহন দত্ত। ইউক্যালিপটাসের বনের মধ্যেকার ছায়াচ্ছন্ন রাস্তাটা দিয়ে বাঁক নিলেই ওই দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। বাঁশের বেড়ার দরজা। ওপারে রয়েছে এক সৃষ্টিমেদুরতা। তালপাতার পুতুল, তালপাতার বাঁশি, তালের আঁটির রবীন্দ্রনাথ, তালগাছের শিল্পাশ্রয়েই মোড়া থাকে সেই অন্তরঙ্গ শিল্পীজীবন। সঙ্গে অবশ্য ফুটনোটের মতো ঘোরে সরকাঠির চরকিরা। ওই মদনবাবুর স্ত্রী সেলাই করছেন টুকরো করে কাটা পাতা, ওই ওঁর বড় মেয়ে আর পুত্রবধূর তুলির টানে প্রাণ পাচ্ছে তলোয়ার বা বন্দুকধারী সেপাই।
আরও শুনুন: পুজোয় প্রেম… শরতেই যেন বসন্তের অকালবোধন
এ ছবি অবশ্য সামনে থেকে দেখা বাস্তব। কিন্তু ওই যে শিল্পের হাতযশ, তার শিকড়-অন্বেষণের একটি ফ্ল্যাশব্যাক আর কিছু পরেই বেজে উঠবে মনে। মদনবাবু বলবেন গল্প। স্বাধীনতা-লাভের সময়ের। চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই শিল্পী শিল্পের কলেবরে তুলে এনেছিলেন নিবিড় প্রতিবাদী স্বর। সেই থেকেই নতুন এক পুতুলের জন্ম। তালপাতার ফিরিঙ্গি। ব্রিটিশ রাজত্বের দুশো বছরের শোষণ যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে এবার কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। সেই পালাবদলের অংশ হয়েছিলেন সেই শিল্পীও। নিজের মতো করেই।
আরও শুনুন: সিংহরাজের কেশর জোড়া আর হাওয়ায় ভাসা পুজোর ছুটি
শিল্পীর নাম দোলগোবিন্দ দত্ত। মদনমোহন দত্তের বাবা। তিরিশ-চল্লিশের দশকের দেশজোড়া গণ-আন্দোলনের ঢেউয়ে মেতে উঠেছিলেন দোলগোবিন্দও। পারিবারিক বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ কোনোদিনই ছিল না। গ্রামের মেটে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে দেশাত্মবোধক যাত্রাপালা, লেটো গানের প্রদর্শন। হাতে খোল-করতাল। কখনও বা হরিনাম সংকীর্তন। দেবতা-প্রেমের চেয়েও সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে স্বাধীনতার স্বাদ। নিজে যাত্রাপালা লিখতেনও। কালস্রোতে অবশ্য সেসব কাগজের সম্পত্তি নৌকা হয়ে ভেসে গেছে। শুধু রয়ে গেছে তাঁর শিল্পটা। তাঁর অকালপ্রয়াণের পরে মদনবাবুর মা-ই ছেলের মধ্যে জারিত করেছিলেন বাবার দর্শন। ‘স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি অগাধ ভক্তি ছিল আমার বাবার’, ফিরিঙ্গি পুতুলটা হাতে ধরে না-দেখা সময়ের কথা রোমন্থনের চেষ্টা চলে মদনবাবুর।
বাকি অংশ শুনে নিন।