নবমীতে আছে আম বাঙালির মাংস খাওয়ার রেওয়াজ। এই প্রথার নেপথ্যেও আছে নির্দিষ্ট কারণ। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিলগ্নে যে সন্ধিপুজো, সেই গল্প জানলেই এই প্রথার শিকড় খুঁজে পাওয়া যাবে। সেই গল্প শোনাচ্ছেন সৌরাংশু।
সন্ধিপুজোর দুটো গল্প আছে। দেবীপূরাণ অনুযায়ী চণ্ড ও মুণ্ড নামক দুই প্রকাণ্ড বলশালী এবং অত্যাচারী দুই অসুরকে বিনাশের জন্য দেবী দুর্গা ভয়ঙ্কর চামুণ্ডা মূর্তি ধারণ করে সংহার করেন ওই অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিমুহূর্তে। আবার রামায়ণ বলে সন্ধিমুহূর্তেই নাকি রামচন্দ্রের ব্রহ্মাস্ত্র রাবণের হৃদয় ভেদ করে।
সন্ধিপুজোয় ১০৭টি পদ্মেরও গল্প আছে। দেবীপূরাণ অনুযায়ী, দেবীর মহিষাসুরের সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধের সময় শরীরে ১০৮টি ক্ষতর সৃষ্টি হয়। মহাদেবের অশ্রু একটি ক্ষতের নিরাময় করে কিন্তু বাকি ১০৭টি ক্ষত থেকে আপনেই পদ্মফুল প্রস্ফুটিত হয়ে নিবারিত হয়।
অন্যদিকে কৃত্তিবাসের রামায়ণে উল্লেখ আছে, রাক্ষসরাজ রাবণকে বধ করার জন্য আশ্বিন মাসেই রামচন্দ্র অকালবোধন করেন। সেখানেও সন্ধিপুজোর বিশেষ তিথিতে দেবীকে ১০৮টি পদ্ম নিবেদন করা হয়। সেই সময় হনুমানকে দেবীদহ থেকে ১০৮টি পদ্ম ফুল তুলে আনতে বলা হয়। কিন্তু সেখানে পাওয়া যায় ১০৭টি পদ্ম। তখন রামচন্দ্র তাঁর নিজের পদ্ম সমান নেত্র দান করার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং দেবী আবির্ভূত হয়ে বরদান করেন যে, তিনি রাবণের থেকে নিজেও সুরক্ষা সরিয়ে নেবেন। অষ্টমী এবং নবমী তিথির মাঝে রামের অস্ত্র প্রবেশ করে এবং দশমীর দিন রাবণের বিনাশ হয়।
আরও শুনুন: মৃত্যু হয় হুদুড় দুর্গার, দুর্গাপুজোর সময় আজও শোকপালন করেন ‘মহিষাসুরের বংশধররা’
এই বঙ্গে সেই কারণে সন্ধিপুজোর পরে আমিষ ভক্ষণের অনুমতি ছিল। যদিও ভিন্ন ভিন্ন স্থানে পুজোর ভোগ হিসাবে মাছ ইত্যাদির চল ছিল। যেমন সাবর্ণ চৌধুরীদের বাড়িতে সন্ধিপুজোয় ল্যাটামাছ পুড়িয়ে ভোগ দেওয়া হত।
নবমীর ভোগ নিয়ে অনেকগুলো চমকপ্রদ গল্প প্রচলিত আছে। এমনি একটি হল ঝাড়গ্রামের কনক দুর্গামন্দিরের গল্প। সাড়ে চারশো বছর আগের সামন্ত রাজাদের ইতিহাস। স্থানীয়দের বিশ্বাস, চারদিকে গভীর জঙ্গলের মধ্যে সামন্ত রাজাদের এই মন্দিরে আজও অষ্টমীর রাতে নিজেই নিজের ভোগ রান্না করেন দেবী। ইতিহাস বলে, চিলকিগড়ের সামন্ত রাজা গোপীনাথ সিংহ তৈরি করেন এই মন্দির। স্বপ্নাদেশ পেয়ে স্ত্রীর হাতের কাঁকন দিয়ে মূর্তি তৈরি করান তিনি। স্থানীয়রা বলেন, আগে নাকি এখানে নরবলি হত। দেবীর নির্দেশে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে বলি আজও হয়। পাঁঠাবলি। অষ্টমীর রাতে। মন্দিরের পাশে গভীর জঙ্গলের মধ্যে। নিশা পুজোয় অংশ নেন শুধুমাত্র পরিবারের সদস্যরাই।
আরও শুনুন: উৎসব সবার… দুর্গাপুজোকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কী নামে ডাকা হয় জানেন?
আম বাঙালির বনেদি পুজোয় মাংস ভক্ষণ নাকি সন্ধিপুজোর পরেই হত। কিন্তু এ তো যে সে মাংস নয়। মায়ের ভোগে যাবে, এ তো ‘নিরামিষ মাংস’। না না পাজামার বুকপকেট গোছের কিছু নয়, নিরামিষ মাংসের অর্থ রান্নায় পেঁয়াজ রসুন ব্যবহৃত হবে না। তাহলে কীভাবে হবে?
খাসির মাংস এক টেবিল চামচ সর্ষের তেল, হলুদ আর দই মাখিয়ে অন্ততঃ ২ ঘণ্টা রেখে দিন।
কড়াইতে সর্ষের তেল গরম করে প্রথমে তেজপাতা ও গোটা গরম মশলা ফোড়ন-সহ মাংস দিয়ে দিন। আঁচ একদম কমিয়ে ঢাকা দিয়ে রেখে রেখে মাংস কষাতে থাকুন।
মাংস তেল ছেড়ে দিলে জিরে, ধনে, পোস্ত, সর্ষে, হলুদ ও লাললঙ্কা বাটা দিয়ে ভালো করে কষুন। মাংস নরম হয়ে গেলে নুন দিয়ে ২ কাপ গরম জল দিয়ে আঁচ বাড়িয়ে ৫ থেকে ৭ মিনিট ফুটিয়ে মাংস নামিয়ে নিন।
সব শেষে একটা বড় হাতায় ২ চামচ তেলে গরমমশলা বাটা দিয়ে ‘ছোঁক’ তৈরি করে মাংসের ঝোলে মিশিয়ে দিয়েই সঙ্গে সঙ্গে চাপা দিয়ে দিন। গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন। অর্থাৎ নিরামিষ মাংস চাইলে ঘরেই বানিয়ে নেওয়া যেতে পারে। বাঙালির পুজো আর পেটপুজো যে কতখানি বৈচিত্রময়, তারই যেন সাক্ষ্য মেলে এই পদে।