আট থেকে আশি, গোয়েন্দা গল্প পড়তে কে না ভালবাসে! সত্যি করে বলুন তো, ছোটবেলায় কখনও কি ইচ্ছে করেনি, ফেলুদা-ব্যোমকেশের মতো রহস্য সন্ধানে হাত পাকাতে! নিদেনপক্ষে, তোপসে কিংবা সন্তুর মতো রহস্যভেদের সঙ্গী হতে! তাহলে জেনে নেওয়া যাক, ভারতে প্রথম কবে এলেন সত্যি গোয়েন্দা?
পুলিশ অফিসার নিজেই নাকি ঠকাচ্ছেন কাউকে! কিংবা যাকে অপরাধী বলে শনাক্ত করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে, তার সঙ্গেই বসে পড়ছেন ধূমপানের আসরে! এও আবার হয় নাকি! আজ্ঞে হ্যাঁ। এমন ছকভাঙা পুলিশ অফিসারই ছিলেন রিচার্ড রিড। অপরাধীকে নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করার জন্য, তার থেকে জবানবন্দি আদায় করার জন্য তিনি করতে পারতেন না হেন কাজ নেই। আর গতানুগতিক পথের বাইরে হাঁটতেন বলেই পুলিশ ব্যবস্থার নির্দিষ্ট ছকের বাইরে সম্পূর্ণ নতুন একটি বিভাগ খোলার পথ দেখিয়েছিলেন তিনিই। যে বিভাগটিকে আজ আমরা চিনি গোয়েন্দা দপ্তর বলে।
আরও শুনুন: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা হত উনিশ শতকের কলকাতায়, বাজির দর উঠত পাঁচশ টাকা পর্যন্ত
ভারতে পুলিশি ব্যবস্থা শুরুই হয় ইংরেজ শাসন জোরদার হওয়ার পর। রিড যখনকার লোক, সেই উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নাম-কা-ওয়াস্তে কিছু তদন্ত হয় মাত্র। তাও রাজধানী শহর কলকাতায়। আর কোনও সাহেবসুবোর কেস হলে পুলিশ একটু নড়েচড়ে বসে। এই পরিস্থিতিতে রিডের হয়তো গোয়েন্দা হওয়া হত না, যদি না ১৮৬৮ সালে একটা অদ্ভুত হত্যাকাণ্ড ঘটত কলকাতার বুকে।
খুনটা হয়েছিল আমহার্স্ট স্ট্রিটে। মারা গিয়েছিলেন এক খ্রিস্টান মহিলা, নাম রোজ ব্রাউন। এই খুনটা পুলিশি তদন্তের ইতিহাসে অনেক দিক দিয়েই বেশ উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, মহিলার দেহ শনাক্ত করার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। তাই কবর দেওয়ার আগে লাশের ফটো তুলে রাখে পুলিশ, যা আগে কখনও হয়নি। দ্বিতীয়ত, পুলিশ যেখানে মহিলাকে শনাক্তই করতে পারেনি, সেখানে রহস্য উদ্ঘাটন তো দূরের কথা। সুতরাং জনতার দরবারে রীতিমতো বেইজ্জত হতে হয় তাদের। আর এই সময়েই এই তদন্তের ভার এককভাবে রিডের হাতে তুলে দেন তখনকার পুলিশ কমিশনার স্টুয়ার্ট হগ। রিড-ই মহিলার মৃতদেহের ছবি সারা শহরে ছড়িয়ে দিয়ে তার পরিচয় খুঁজে পান, এমনকি খুঁজে পান তার বাড়ির ঠিকানা, প্রেমিকার হদিশও। এই কেসের ফলাফল কী হল, সে প্রসঙ্গে যাব না। কিন্তু এই কেসের ফলেই যেটা হল, আলাদা একটা গোয়েন্দা বিভাগ খোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন ব্রিটিশ পুলিশের বড়কর্তারা। কিছুদিন দুই বিভাগের টানাপোড়েন, পুলিশ-গোয়েন্দার মান-অভিমানের লড়াই চলল বটে, কিন্তু শেষমেশ বিভাগটা টিকে গেল। আর রিচার্ড রিড একই সঙ্গে হলেন গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর এবং সুপারিন্টেনডেন্ট।
আরও শুনুন: ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল, চক্রান্তের স্বীকার হয়েছিলেন দেশের প্রথম মহিলা ডাক্তার Kadambini Ganguly!
প্রথাগত পদ্ধতিতে রহস্যভেদের দিকে যেতেন না রিড। তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন মানুষের অভিব্যক্তিকে। ভারত সরকারের প্রাক্তন মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল বার্ন-এর বাড়িতে টাকা চুরির কেস সলভ করেছিলেন চাকরদের হাবভাব, মুখের চেহারা খুঁটিয়ে দেখে। আবার প্রয়োজনে অপরাধীদের রীতিমতো ফাঁদে ফেলে পাকড়াও করতেন তিনি। যেমন, এক পেশাদার ঠক পালিয়েছিল ফরাসিদের অধিকৃত এলাকায়। সেখানে তো ব্রিটিশ সরকারের জারিজুরি খাটবে না! রিড করলেন কী, সেই ঠককে নিমন্ত্রণ করলেন নৌকাবিহারে। তাতে স্বল্পবসনা সুন্দরী মেয়ে, নেশার জিনিস, সবই মজুত। এইসব নেশায় যখন সে মাতোয়ারা, নৌকার মুখ ঘুরে গেল। ফরাসি রাজত্ব থেকে সোজা ব্রিটিশ উপনিবেশে, পুলিশের কবজায় এসে পড়ল সেই ঠক।
১৮৮৭ সালে নিজের পুলিশি অভিজ্ঞতা, তদন্তের কাহিনি সংকলিত করে রিড প্রকাশ করেন ‘এভরি ম্যান হিজ ওন ডিটেকটিভ’ বইটি। একই বছর লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় আর্থার কোনান ডয়েল-এর ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’। শার্লক হোমস-এর প্রথম বই। সমাপতনই বটে। কিন্তু এরপর যদি রিচার্ড রিডকে কলকাতার ‘শার্লক হোমস’ বলা হয়, খুব অন্যায় হবে কি?