নবরাত্রি অথবা আমাদের শারদীয়া দুর্গাপূজার সময়ে পাঠ হয় দেবীমাহাত্ম্যম্। বঙ্গদেশে দেবীমাহাত্ম্যম্ পাঠকে বলা হয় চণ্ডীপাঠ। বাংলার নানা ঘরোয়া কল্যাণকর অনুষ্ঠানেও প্রথা রয়েছে চণ্ডীপাঠের। সাধারণ মানুষের কল্যাণ কামনায় হয় চণ্ডীযজ্ঞ। সেখানেও অবশ্য পালনীয় এক আচার, চণ্ডীপাঠ। কিন্তু কি এই চণ্ডীপাঠ! পুরাণমতে জানা যায় এই চণ্ডীপাঠের নেপথ্যে রয়েছেন ঋষি মার্কণ্ডেয়। কীভাবে তিনি চণ্ডীতত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত! সেই কথাই শোনাচ্ছেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।
শাক্তধর্মের সর্বোচ্চ গ্রন্থ দেবীমাহাত্ম্যম্। এই গ্রন্থ পরিচিত দুর্গা সপ্তশতী বা চণ্ডী নামেও। দেবী পার্বতী কীভাবে কাত্যায়নী রূপে মহিষাসুর বিনাশ করেছিলেন, সেই বিনাশ এবং বিজয়কাহিনী এখানে বর্ণিত। কথিত আছে, ঋষি মার্কণ্ডেয় এই গ্রন্থের প্রণেতা।
দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থের বিশিষ্টতাই হল এই গ্রন্থ পাঠের প্রথা। ধর্মগ্রন্থ পাঠ এবং শ্রবণ হিন্দুধর্মের অত্যন্ত প্রাচীন এক প্রথা। গুরুকুলের আমলে বেদ উপনিষদ্ পাঠ এবং শিক্ষাদান হতো। এমনকি কার্ত্তিক মাসে গ্রামাঞ্চলে এখনও প্রথা রয়েছে মহাভারত পাঠের। হিন্দু গৃহস্থের শ্রাদ্ধে প্রথা রয়েছে শ্রীমাদ্ভগাবত পাঠের। তেমনই যাগ-যজ্ঞ সহ গৃহের মঙ্গলানুষ্ঠানে দেবীমাহাত্ম্যম্ বা চণ্ডী পাঠের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সমগ্র চণ্ডীকে একটি মহামন্ত্র, মনে করা হয়।
আরও শুনুন: Spiritual: শাস্ত্রে গৃহস্থদের পাপ মুক্তির জন্য কী ধরনের যজ্ঞবিধি রয়েছে?
সাধারণ মানুষের চণ্ডীপাঠ নিয়ে রয়েছে নানা লোকবিশ্বাস। যেমন, ব্রাহ্মণ না হলে চণ্ডীপাঠ করতে নেই। চণ্ডীপাঠে উৎপন্ন হয় ক্ষাত্রতেজ। পাঠে ভ্রান্তি হলে পাঠক এবং গৃহস্থের অকল্যাণ হয় ইত্যাদি। তাই শাক্ত আরাধনার অন্যতম আকর এই গ্রন্থ পাঠ করতে অনেকেই ভয় পান।
কথিত আছে, মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১-৯৩ অধ্যায়গুলি নিয়ে সম্পাদিত হয়েছিল দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থটি। ঋষি মার্কণ্ডেয় জৈমিনী সহ তাঁর শিষ্যদের নিকট এই পুরাণের উপাখ্যানগুলি ব্যক্ত করেছিলেন।
মার্কণ্ডেয় পুরাণের মূল চরিত্র মার্কণ্ডেয়। তিনি ঋষি মৃকন্ডুর পুত্র। মহাভারতে উল্লিখিত, এই বিশ্ব সংসারে অবিরত যে ধ্বংস এবং সৃষ্টির খেলা চলছে সেই সমস্ত খেলার সাক্ষী তিনি। তিনি প্রজাপতির ব্রহ্মার নেত্রমধ্যে অবস্থিত কর্নিকায় অবস্থানকালে, প্রত্যক্ষ করছেন, জগতের নিরন্তর ধ্বংস এবং সৃষ্টির এই অবিরল ক্রীড়া। মার্কণ্ডেয় চিরজীবী, তাঁর মৃত্যু নেই। তিনি মহাশক্তির অত্যন্ত গূঢ়তত্ত্ব জানেন। কিন্তু কীভাবে তিনি জন্ম মৃত্যুর কালচক্র পেরিয়ে চিরজীবী হলেন?
এই বিষয়ে বর্ণনা মেলে নারসিংহ পুরাণে।
আরও শুনুন: Spiritual: নাম-সংকীর্তনে কী ফল মেলে?
মার্কণ্ডেয়র জন্মের পর তাঁর মাতা সুমিত্রা একটি দৈববাণী শুনেছিলেন, ‘এই সন্তানের আয়ু বারো বছর। বারো বছর পর এই সন্তাননের মৃত্যু হবে।’
মার্কণ্ডেয় আর পাঁচজন ঋষিপুত্রের মতো বড় হতে লাগলেন। গুরুগৃহে অধ্যয়নে নানা শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে লাগলেন, কিন্তু দেখেন তাঁর পিতা মাতা সবসময়ই বিমর্ষ হয়ে থাকেন। ক্রমে মার্কণ্ডেয়র বয়স বারো হল। তিনি দেখলেন, তাঁর মাতা পিতার বিমর্ষতা হয়ে উঠেছে পাহাড় প্রমাণ। হয়েছে দুর্লঙ্ঘ্য। কিছুতেই যেন সেই পাহাড় অতিক্রম করা যায়না। তিনি তাঁর মাতাপিতাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা সর্বক্ষণ কেন এত বিমর্ষ থাকেন?’