রাজনৈতিক সদিচ্ছাতেও মন্দের সঙ্গে কালোর তুলনা টেনে আনা এক ধরনের বদভ্যেস। ‘অত্যাচারীর কালো হাত ভেঙে দাও -গুঁড়িয়ে দাও’ মার্কা স্লোগানের ভিতর অবহেলিতের ন্যায় ও ন্যায্যতার যে শুভ বার্তাই থাকুক না কেন, আদতে তা প্রাচীন বর্ণবাদকেই বয়ে নিয়ে চলে।
‘কালো অলক্ষুণে/ পায়ে খুরঅলা ধিঙ্গি মেয়ে’ বউমা হয়ে শাশুড়িকে একেবারে ভাবনায় এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিয়েছিল। শাশুড়ির মনে তো হয়েছিল ‘নোড়া দিয়ে মুখ ভেঙে দিতে হয়’! তাতেও সে ‘কালো মেয়ে’ দমেনি একফোঁটা। তদন্তে কান খাড়া করে আড়ি পেতে শাশুড়ি অবশেষে শুনেছিল, আগত সন্তানের নাম সে-মেয়ে রাখতে চলেছে আফ্রিকা। কেননা, ‘কালো মানুষেরা কী কাণ্ডই না করছে সেখানে।’ ১৯৬২-তে সুভাষ মুখোপাধ্যায় যে ‘মেজাজ’ চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন, এই ২০২৫-এ এসে সে-কবিতাই যেন জীবনের বর্ণমালায় লিখলেন কেরলের মুখ্যসচিব সারদা মুরলীধরণ। গায়ের রং কালো বলে ‘খোঁটা’ শুনে তিনি পালটা জানিয়ে দিয়েছেন যে, কালো এবং মহিলা এই দুই পরিচয় স্বীকার করে নিতে তাঁর অন্তত কোনও দ্বিধা নেই। একই সঙ্গে স্পষ্ট হল, বর্ণবিদ্বেষী এ-সমাজের জগদ্দল এখনও বর্তমান বহাল তবিয়তে।
সাফল্য যদি নিরিখ হত, তাহলে তাঁর উদ্দেশে বর্ণবিদ্বেষী কটূক্তি ধেয়ে আসত না। সে-রাজ্যের প্রথম মহিলা আইএএস অফিসার হিসাবে এই পদে পৌঁছেছেন তিনি। জনৈক ব্যক্তি তাঁর কাজকর্মকে তাঁর গায়ের রঙের সঙ্গে তুলনা করেছেন। একই সঙ্গে জানিয়েছেন যে, তাঁর পূর্বসূরির আমল বরং অনেক সাফসুতরো ছিল। ঘটনাচক্রে সেই পূর্বসূরি সারদার স্বামী। এর জবাব সারদা দিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রথমে তিনি পোস্ট ডিলিট করেছিলেন বটে, তবে, শেষমেশ তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করাই সমীচীন বোধ করেছেন। তাঁর এই পদক্ষেপ দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিআক্রমণের জবাব দেওয়া শুধু নয়, এই সমাজের চোরা বর্ণবিদ্বেষের রূপটিকেই তিনি টেনে এনেছেন প্রগতির হাটের মাঝে। সংবাদসংস্থা এএনআই-কে তিনি জানিয়েছেন, তাঁর উদ্দেশে ধেয়ে আসা মন্তব্যের নেপথ্যে আছে সেই গোঁড়া ধারণা- যা কিছু মন্দ তাই-ই আসলে কালো। কালো-র সঙ্গে মন্দের এই যে যোগসূত্র তা কতটা মনগড়া ধারণা আর কতখানি বাস্তবতা? এ-প্রশ্নই তিনি তুলেছেন। আর এই নিরিখেই তাঁর এই প্রতিবাদ-বক্তব্য এই সময়ে দাঁড়িয়ে প্রতিস্পর্ধার এক বয়ানই হয়ে উঠেছে।
সারদা মুরলীধরণ স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছেন, সুন্দরের সঙ্গে রং-এর ধারণা মেলানো এক প্রাচীন কুসংস্কার। কারণ, সৌন্দর্যের ধারণা কখনই গায়ের রঙের উপর নির্ভর করে না। সাদার যে আধিপত্যবাদ তা এ-দেশ পেয়েছে ঔপনিবেশিকতার সূত্রেই। নইলে এ-দেশ কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলোর নাচন দেখতে ভুল করেনি। সুন্দরের রসাস্বাদনের যে বৃহত্তর প্রেক্ষা, সেই দৃষ্টিই ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে বর্ণবাদী মানসিকতায়। আর এ মানসিকতার দরুন বেশি হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে মহিলাদেরই। বহুবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় লিঙ্গসাম্য যেখানে এখনও বহুদূরের বিষয়, সেখানে বর্ণভেদ তাঁদের কোণঠাসা করেছে যুগ যুগ ধরে। পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থার আধিপত্যের হাত মজবুত করেছে এই ধারণা। দুঃখের বিষয় যে, আধুনিকতার পথে বহুদূর হেঁটে এসেও এখনও এই মানসিকতা থেকে মুক্ত হয়নি ভারতীয় সমাজব্যবস্থা। খাতায়-কলমে, সংবিধানে যা-ই থাকুক না কেন, এ-দেশে সংখ্যালঘু, দলিতের অবস্থানের কাছাকাছি থাকেন কালো মানুষেরা। লিঙ্গবৈষম্যের নিরিখে মহিলাদেরও অবস্থান এই সারিতেই। অর্থাৎ সামগ্রিক ভাবে তথাকথিত প্রগতিশীল সমাজের কাঠামোয় এঁরা যেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকই। এই কাঠামোর একেবারে গোড়াতেই ধাক্কা দিয়েছেন সারদা মুরলীধরণ। তিনি নারী এবং কালো- এ কথা মেনে নেন নির্দ্বিধায়। আর এই মেনে নেওয়ার ভিতরই থাকে তাঁর প্রশ্ন, কালো মেয়ে তো কী হয়েছে? এই প্রশ্নের মুখে পড়েই থতমত ২০২৫-এর ভারত।
সুতরাং সারদা মুরলীধরণের এই বক্তব্য যেন দেশবাসীর ভাবনাজগতে এক আন্দোলনেরই জন্ম দেয়। এমনকী রাজনৈতিক সদিচ্ছাতেও মন্দের সঙ্গে কালোর তুলনা টেনে আনা এক ধরনের বদভ্যেস। ‘অত্যাচারীর কালো হাত ভেঙে দাও -গুঁড়িয়ে দাও’ মার্কা স্লোগানের ভিতর অবহেলিতের ন্যায় ও ন্যায্যতার যে শুভ বার্তাই থাকুক না কেন, আদতে তা প্রাচীন বর্ণবাদকেই বয়ে নিয়ে চলে। দেশ বদলেছে। সময় বদলেছে। পুঁজিনিয়ন্ত্রিত বাজার এই সত্য বুঝেছে দ্রুত। ২০২০ সালে হিন্দুস্তান ইউনিলিভার ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ প্রোডাক্ট থেকে মুক্তি দিয়েছে ‘ফেয়ার’ শব্দটিকে। নাগরিক সমাজে তা যথেষ্ট সাধুবাদ পেয়েছে। সমাজের এক স্তরে হয়তো বর্ণভেদ নিয়ে তেমন কোনও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু উপরিকাঠামোর এই বদল, বুনিয়াদি মানসিকতাকে যে সেভাবে বদলাতে পারেনি, সারদা মুরলীধরণের ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়ে দিল। এই তো কিছুদিন আগেই আইপিএল-এ ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে আর্চারকে কালো ট্যাক্সির সঙ্গে তুলনা করে ফেলেছেন হরভজন সিং। এই সব বক্তব্যেরই উৎস এক। যে বর্ণবাদী, জাতপাতিভিত্তিক সমাজকে পেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তা যেন এখনও পিছনে টানছে নতুন দেশকে।
অতএব, ভারতীয়দের ভাবা উচিত বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে এ লড়াই কারা লড়বে? তা কি একা সারদা মুরলীধরণের? বা এ দেশের কালো মানুষদের? নাকি, সমস্ত নাগরিকেরই! দৈনন্দিন ব্যবহারে কালোর সঙ্গে মন্দের যোগ ঘটানোর চশমাখানা নামিয়ে রাখার অনুশীলন শুরু না করলে, এ কুসংস্কার দূর হবে না। সারদা মুরলীধরণের এই প্রতিবাদ তাই কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যক্তির জবাব শুধু নয়; বরং এই দেশের সামনেই নতুন ভাবনার পরিসর খুলে দেওয়া।
আজীবন কালো মানুষের জন্যা লড়াই করেছেন যিনি, সেই নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর লড়াইকে বলেছিলেন ‘হিউম্যান ডিগনিটি’ অর্থাৎ মানুষের মর্যাদার লড়াই। মানবিকতার লড়াই। সে লড়াই ভারতবাসী এখনও লড়তে না পারলে, মুক্ত সমাজের কল্পনা অধরাই থেকে যায়। আদতে তা শক্ত করবে আধিপত্যবাদের হাতকেই। দেশের ভবিষ্যতের জন্য তা কতখানি শ্রেয় তা ভেবে দেখার সময় এসেছে বইকি!