ডিজিটাল যুগে খেলা সম্প্রচারেও ওটিটির দাপট। তবু ক্রিকেট দেখায় ভরসা সেই টেলিভিশন। এতদিন ধরে খেলা দেখার যে চল, তা বদলায়নি আজও। কোন জাদুতে? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
এপ্রিল ২, ২০১১। রাস্তাঘাট শুনশান। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে, তাও। মাঝে মধ্যে জটলা। টিভির পর্দায় কয়েকজোড়া উৎসুক চোখ। মাথা উঁচু করলেই ভারতের পতাকা নজরে পড়বে। অন্ধকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনার পারদ বাড়ছে। একটা ছক্কা, একটা উইকেট, চিৎকার, উল্লাস, কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু আতশবাজির দাপট! দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জিতল ভারত। চারিদিকে উৎসবের আমেজ। এই সময়টায় একজনের রাজত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো, টেলিভিশন। পাড়ার, বাড়ির, হোস্টেলের, রেস্তোরাঁর সবেধন নীলমণি, টেলিভিশন।
তারপর কেটেছে অনেকগুলো বছর। সদ্য চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছে ভারত। খেলার সম্প্রচার হয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এবং টেলিভিশনে। মোবাইলের স্ক্রিনে খেলা চলাকালীন বড় বড় করে দেখানো হয়েছে ঠিক কতজন সেই মুহূর্তে খেলা দেখছেন। কোনওবারই সংখ্যাটা তেমন ছোট ছিল না। তাহলে কি খেলা দেখার অভ্যাস বদেলেছে? একেবারেই না। সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, মোবাইল বা ওটিটির জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও টিভিতে খেলা দেখা একেবারেই কমেনি। বরং কেউ কেউ ছবির গুণগত মানের বিচারে টেলিভিশনকেই বেছেছেন। আসলে, খেলা হল এমন একটা বিনোদনের মাধ্যম যা একা একা উপভোগ করা যায় না। তাইতো ১৯৮৩, ২০০৩, ২০০৭, ২০১৩… বছরের পর বছর ধরে যে ছবি দেখতে এ দেশ অভ্যস্ত, তা এবারেও তেমন বদলায়নি। হয়তো একইসঙ্গে মোবাইল আর টিভি দুই জায়গায় খেলা চলেছে, কিন্তু টিভিকে ভুলে গিয়ে স্রেফ মোবাইলে মুখ গুঁজতে নারাজ অধিকাংশ ক্রিকেটপ্রেমী।
একটা সময় রেডিওতে খেলার সম্প্রচার হত। ৮৩’র বিশ্বকাপের সময়েও এই মাধ্যমই অধিক জনপ্রিয় ছিল। কারণ টিভি কেনার সামর্থ্য সকলের ছিল না। আর বিশ্বকাপের সমস্ত ম্যাচ তাতে সম্প্রচারও হয়নি। অগত্যা রেডিও-ই ভরসা। কিন্তু কিছু দেখার উপায় নেই। স্রেফ কানে শোনা যাবে। একসঙ্গে বসে তাই শুনতেন সকলে। ‘কপিল দেব ছয় মারলেন’, তা শুনেই লাফিয়ে উঠতেন সবাই। একা একা কেউ রেডিওতে খেলার কমেন্ট্রি শুনছেন এমন দৃশ্য ছিল রীতিমতো বিরল। তাই একসঙ্গে খেলা দেখা বা শোনার অভ্যাস যে বহুদিনের, এমনটা বলাই যায়। এরপর টেলিভিশন এল। সাদাকালো ছবি। তাও অ্যান্টেনা একটু এদিক ওদিক হলেই গেল! স্ক্রিনে ভেসে উঠবে ভাঙাচোরা ছবি, ঝিরঝির করবে পর্দা, কিছু বোঝার উপায় থাকবে না। উত্তেজনার ম্যাচে এমন বাধা সঙ্গে নিয়েও সকলে খেলা দেখতেন। উপায়ও ছিল না অবশ্য। ধীরে ধীরে টিভির উন্নতি, পর্দায় রঙিন ছবি, রেডিওর কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে যাওয়া, অনেক বদল হল। কেবল একটা জিনিস বাদে। একইসঙ্গে বসে খেলা দেখার অভ্যাস। ক্রিকেটের বিশ্বমঞ্চে ভারতের দাপটও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল। টেস্ট, ওয়ান-ডে, টি-টোয়েন্টি সব ফরম্যাটেই জাত চেনাতে শুরু করল টিম ইন্ডিয়া। শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড় জমানা পেরিয়ে ধোনি-কোহলি-রোহিত এলেন। এরইমাঝে বেশ কয়েকবার বিশ্বজয়ের স্বাদ পেল ভারত। কখনও টি-টোয়েন্টি কখনও ওয়ান ডে। টেস্ট ক্রিকেটেও একাধিক নজির বিহীন কৃতিত্ব হাসিল করেছে মেন ইন ব্লু। আর এই সবকিছুর সাক্ষী থেকেছেন এদেশের ক্রিকেট ফ্যানরা। তাও টেলিভিশনের মাধ্যমে। ইতিমধ্যে আইপিএল শুরু হল। ভারতীয় ক্রিকেট বিনোদনের নতুন অধ্যায় জুড়ল। তাতে টেলিভিশনের রমরমা যেন আরও বাড়ল। দেশের খেলোয়াড়রা একে অন্যের বিরুদ্ধে মাঠে নামছেন, জাতীয় দোলের সমর্থকরা ভাগ হচ্ছেন পছন্দের ক্রিকেটার বা রাজ্যের ভিত্তিতে। সবের কেন্দ্রে সেই টেলিভিশন। কোন সময় কার খেলা বড় করে তা ছাপা হত খবরের কাগজে। অনেকেই সেই সূচী কেটে রাখতেন। সব কাজ সামলে যথাসময়ে টিভির সামনে বসা। আইপিএল ম্যাচ পাড়ার ক্লাবে তুমুল উত্তেজনা তৈরি করেছে, এই ছবিও খুব একটা পুরনো নয়। কেউ কেউ আপত্তি তুলেছেন, ক্রিকেটের বানিজ্যিকরণ দেখে মুখ ঘুরিয়েছেন। তাতে অবশ্য তেমন ফারাক পড়েনি। কারণ, আইপিএল নিয়ে অনেকেরই উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মতো।
এসবের মাঝে ২জি, ৩জি, ৪জি পেরিয়ে ৫জি এল। টেলিভিশনের সঙ্গে ক্রিকেট সম্পচারের দখল নিল ওটিটি। যখন খুশি যেখান থেকে খুশি খেলা দেখো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিনামূল্যে। সুবিধা অনেক। অফিস ফেরতা বাসে, ট্রামে খেলা দেখা। ঘুমোনোর আগে বিছানায় শুয়ে খেলা দেখা। সবই হতে পারে। কিন্তু স্রেফ খেলা দেখা টুকুই হবে। খেলার ফলাফলের সঙ্গে উত্তেজনার পারদ যেভাবে ওঠানামা করে, সেটা উপভোগ করা হবে না। আর তাই বোধহয়, এত সুবিধা সত্ত্বেও টিভির দর্শক কমেনি। সদ্য শেষ হওয়া চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ওটিটিতে যতজন দেখেছেন, টিভিতেও প্রায় সেই সংখ্যক মানুষই দেখেছেন। কেউ কেউ দু জায়গাতেই চোখ রেখেছেন। সবমিলিয়ে সেই বছরের পর বছর ধরে জীবন্ত হতে থাকা ছবিটা, এবারও বদলায়নি। পাড়ার ক্লাব, কলজের হোস্টেল, মেসবাড়ি কিংবা রেস্তোরাঁতেও উৎসুক চোখে ক্রিকেট দেখেছেন অনেকেই। যা অনায়াসে প্রমাণ করেছে, খেলা দেখায় ‘প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ’ টেলিভিশনই।