নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে তৃতীয়বারের জন্য আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির খেতাব জিতল ভারত। প্রশ্নাতীতভাবেই গোটা টুর্নামেন্টে দল হিসাবে সবচেয়ে ভালো পারফর্ম করেছে মেন ইন ব্লু। ব্যাটিং থেকে বোলিং, আর কোনও দল সেভাবে ভারতের ধারেকাছেও আসতে পারেনি। আর সেটাই হয়তো রোহিতদের সাফল্যের আসল চাবিকাঠি।
রূপকথার গল্পে নায়ক একজন। তবে তাঁকে সাহায্যের জন্য সবসময় কেউ না কেউ এগিয়ে আসেন। কখনও তাঁরা সংখ্যায় একাধিক। নায়কের জয় তাঁদের জীবনেও পরিবর্তন আনে। তবে সকলেই যে রানি কিংবা রাজ্যপাট পান তা নয়। বরং অন্য কোনও গল্পে তাঁরাও নায়ক হওয়ার দৌড় শুরু করেন। সেখানে আবার এই গল্পের নায়ক, সহকারী, যোদ্ধা।
আরও শুনুন:
কামব্যাকের গল্পে রোহিত শর্মা, তুলনারহিতই বটে!
বর্তমান ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলকেও এমনই কোনও গল্পের চরিত্রদের সঙ্গে তুলনা করাই যায়। সেখানে একা বিরাট নায়ক হয়ে সব লড়াই জিততে পারেন না। রোহিত-হার্দিক, বরুণ-শামিদের প্রয়োজন হয়। আবার কোনও গল্পে, বিরাট হয়ে ওঠেন যোগ্য সহকারী। সেক্ষেত্রে নায়ক অন্য কেউ। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল ম্যাচের কথা ভাবলে, রোহিত শর্মা। তাই বলে কি সাফল্যের আলো একা নায়ককে উদ্ভাসিত করে? একেবারেই নয়। বরং তা ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে। সেই আলো গায়ে মেখে নেচে ওঠেন সবাই। যাকে নিয়ে গোটা খেলায় সেইভাবে চর্চা হয় না, সেই শ্রেয়স আইয়ারও!
আরও শুনুন:
সমস্যা সত্ত্বেও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আয়োজনকে বড় সাফল্য হিসেবেই দেখছে পাকিস্তান, কোন যুক্তিতে?
অবশ্য চর্চার সংজ্ঞাটাও এখন বদলেছে। ‘নতুন ভারত’ বলতে ভারতের নতুন খেলোয়াড়ের দলকে বোধহয় আর বোঝায় না। তাতে ইঙ্গিত মেলে রাজনৈতিক পালাবদলের। বলা ভালো, শক্তি প্রদর্শনের। চর্চার নামে কারও চেহারা নিয়ে কটাক্ষ করা যায়, হোক না তিনি ভারতের অধিনায়ক! কিংবা অনায়াসে দাবি করা যায় শামি মানেই সংখ্যালঘু! তা সে ব্যর্থতা বা সাফল্য, যাই আসুক। সমালোচনার ভাষা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও বিপদ! তাকে ভাষার সমালোচনা বলে ধরে নেওয়া হবে, কড়া ভাষায় ছুটে আসবে জবাব। অথচ এই সেদিনও ক্রিকেট কিংবা ক্রিকেটাও চর্চা বলতে অন্য কিছু বুঝত ভারত। মহম্মদ আজহারউদ্দিনের কবজির মোচড়। কিংবা ভিভিএস লক্ষ্মণের হাতের তাস! ক্রিকেটের ক্যানভাসে আঁকা এইসব অনবদ্য শিল্পসুষমাই ছিল ক্রিকেটীয় চর্চার আলোচ্য বিষয়। রানের হিসাবশাস্ত্র বাদ দিলে, নন্দনতত্ত্বের নিরিখে কে কোন অবস্থানে, তা নিয়েই তুলনামূলক আলোচনা চলত। সেখানে আর যাই থাকুক, ক্রিকেটারের ধর্ম ছিল না। কিংবা ধরা যাক পয়েন্টে দাঁড়িয়ে যুবরাজ সিং-এর উড়ন্ত পাখি হয়ে ওঠার গল্প। অথবা মহম্মদ কাইফের অবিশ্বাস্য দৌড়ে বল তালুবন্দি করে নেওয়ার জ্যান্ত দৃশ্য। কে বেশি জন্টি রোডস্! তাই নিয়েই ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে চলত মৃদু গুনগুন, চাপা ফিসফাস। সেসব তো মাত্র এই সেদিনের কথা। ক্রিকেট সেদিনও ছিল শুধু ক্রিকেটেই। ক্রিকেটীয় উৎকর্ষই বিচারের একমাত্র মাপকাঠি। সেখান থেকে ধর্ম, রাজনীতি, আর পরিবর্তনের হাওয়া এসে সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। তাতে ক্রিকেটের ক্ষতি হয়েছে অস্বীকারের উপায় নেই। তবে ভারতের দল হয়তো তেমন প্রভাবিত হয়নি।
আরও শুনুন:
রোহিত শর্মার চেহারা খেলার যোগ্য কি না, ঠিক করবে সোশাল মিডিয়া?
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল ম্যাচের দিকে তাকালেই সেকথা প্রমাণ হতে পারে। যে মহম্মদ শামি ক্যাচ মিস করায় সোশাল মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠল, সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিতেই কটাক্ষ ভেসে এল, সেই শামির মা-কে দেখে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন বিরাট কোহলি। মনে হতেই পারে এই ঘটনা একেবারে সাধারণ। হয়তো তাই। বিরাট নিজেও হয়তো এতশত ভেবে এমনটা করেননি। কিন্তু যে আবহে এই ঘটনা ঘটছে, আর বিরাটের মতো খেলোয়াড় অবলীলায় মাটি ছুঁয়ে দেখছেন, তার প্রশংসা করাই যায়। ভারতীয় ক্রিকেটে ব্যক্তিপুজোর অভ্যাস নতুন নয়। সেই হিসাবে বিরাট-রোহিত চর্চায় থাকবেন, এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ট্রফি হাতে সতীর্থদের সঙ্গে তাঁদের উল্লাস কিংবা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ম্যাচ জেতা, ‘নতুন’ ভারতের গল্প বলছে বইকী! ফাইনাল ম্যাচে রোহিতের ব্যাটে সেঞ্চুরির স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেকেই। শুভমনের সঙ্গে দুরন্ত পার্টনারশিপ দেখে অনেকেই ভেবেছিলেন, এঁরাই দায়িত্ব নিয়ে ম্যাচ জেতাবেন। আচমকা শুভমনের উইকেট পতন বড়সর ধাক্কা দেয়। তবু সেই ধাক্কা ম্যাচ জেতা নিয়ে ছিল না, সকলেই একপ্রকার নিশ্চিত ছিলেন, বাকিটা কোহলি সামনে নেবেন! কিন্তু বিধি বাম, কোহলি এলেন আর গেলেন। আশাভঙ্গ নিঃসন্দেহে, কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ নয়। কারণ তখনও ক্রিজে ছিলেন রোহিত শর্মা। বেশিক্ষণ নয় অবশ্য, হিটম্যানও আউট হলেন ৭৬ রানে। এরপর কী হবে, সেই নিয়ে অনেকের কপালেই চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল। কিন্তু অক্ষর-শ্রেয়সের দুরন্ত পার্টনারশিপ বুঝিয়ে দিয়েছে, দল বলতে আসলে কী বোঝায়। তাতেও ম্যাচ জয় নিশ্চিত ছিল না। সেই দায়িত্ব ভাগ করে নেন হার্দিক-জাদেজা। প্রত্যেকটা রান কতটা প্রয়োজনীয় হতে পারে, এদিনের ম্যাচে তা বেশ বোঝা গিয়েছে। ততক্ষণে অবশ্য দ্বেষের পাহাড় ভালোই মজবুত হয়েছে। সোশাল মিডিয়ায় থেকে একের পর এক কটাক্ষ ভেসে এসেছে, প্রশ্ন উঠেছে, তাতে এতটুকু বিচলিত হয়নি টিম ইন্ডিয়া। নিজেদের ছন্দে নিজেদের কাজটা তাঁরা করে গিয়েছেন। ম্যাচ জেতার ক্ষেত্রে কোনও একজনের কাঁধে ভর করলে চলে না, তাই প্রমাণ হয়েছে। আসলে ক্রিকেট হল ব্যাকরণ-ভাঙা খেলা। শঙ্করীপ্রসাদ বসু বলেছিলেন ‘ভূগোল-ভাঙা’। যে খেলা সব মানচিত্র মুছে দিয়ে সর্বজনীন নায়কের জন্ম দেয়, আবার স্বতন্ত্র ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যকে হেলাফেলা করে না। এই ধারণাটুকু ধার করে নিয়ে আমরা বলতে পারি, ক্রিকেট আসলে সেই ব্যাকরণ, যা নিজেকেই ভেঙেচুরে নতুন ব্যাকরণ গড়ে নেয়।