প্রত্যেক বছর অস্কারমঞ্চে ঘটে নজিরবিহীন ঘটনা। আর সেই ঘটনাই দর্শকের মনে থেকে যায় আজীবন। এই বছরেও তার ব্যতিক্রম হয়েনি। ‘নো আদার ল্যান্ড’ তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করেন প্যালেস্তাইন ও ইজরায়েলের পরিচালকরা। এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে থেকেই তাঁরা যৌথস্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু কার উদ্দেশ্যে? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
আলু আর আলুবখরা। চাল আর চালকুমড়ো। জল আর জলপাই। এক নয়। এক নয়, পুরস্কার আর আনুগত্য। যে কোনও দুটি বিষয়ের মাঝে সমান চিহ্ন বসিয়ে দেওয়া প্রাচীন এক কুসংস্কার। সেভাবেই বসেছিল, হয়তো বা। অনুগত জন প্রবঞ্চনা সইতে পারে না। আবার উলটোটাও সত্যি। মানুষের চরিত্র বিচিত্র কিনা! অতএব তালেগোলে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল যে, পুরস্কার যেন আনুগত্যেরই স্মারক। অথবা তা যদি না-ও হয় প্রাথমিক ভাবে, তার পরে, অর্থাৎ ধরে নেওয়া যেতে পারে যে পুরস্কৃত হওয়ার পর একজন ব্যক্তি, পুরস্কারদাতার অনুগত হয়েই থাকবেন। মুখে কুলুপ। পুরস্কার-রাজনীতির গোড়া আর গেরো এইখানেই। ঠিক এই কারণেই হোয়াটাবাউটারি যখন সাংস্কৃতিক ছদ্মবেশ নেয়, তখন প্রশ্ন ওঠে, ‘কই অমুকের থেকে পুরস্কার নেওয়ার সময় মনে ছিল না?’, কিংবা, ‘অমুক ঘটনার পর পুরস্কার না ফেরালে এখন কেন?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। পুরস্কার আর আনুগত্যের সম্পর্কটি অতএব বাস্তবিক গোলমেলে। তবে, সর্বদা যে হিসাব মেলে তা নয়। কেউ কেউ হিসাব ভেঙে দেন। যেমন, ‘নো আদার ল্যান্ড’ তথ্যচত্রটির পরিচালকরা।
:আরও শুনুন:
শতবর্ষ পেরনো সিনেযাত্রায় ‘একটুকু ছোঁয়া’, এটুকুই! নোলানের সবিনয় নিবেদন
তথ্য এটুকুই যে, ‘নো আদার ল্যান্ড’ তথ্যচিত্রটি অস্কার জিতেছে। ঘটনা হল যে, তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করেন প্যালেস্তাইন ও ইজরায়েলের পরিচালকরা, যৌথভাবে। ইজরায়েলি আগ্রাসনে প্যালেস্তাইনের মুছে যাওয়া, নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ভ্যানিস হয়ে যাওয়ার তথ্য ধরে রাখার প্রক্রিয়া চলেছিল ২০১৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত। তারপরই আসরে হামাস। বাকি ইতিহাস গোটা বিশ্ব জানে। বিশ্ব জানে যে, কে কোন ভূমিকা পালন করেছে। গাজার যন্ত্রণা কোন মুলুকের বুকে কতখানি বিঁধেছিল আর কে কে মৌনব্রত পালন করেছিল, সমসময়ের ইতিহাস নিশ্চিতই তার সাক্ষ্য দেবে। অনেক রক্তক্ষয়ের পর যুদ্ধবিরতি এসেছে। সেই আবহে, এই তথ্যচিত্রের অস্কার-প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। তবে, সবথেকে বড় কথা এই যে, পুরস্কার, পরিচালকদের যৌথস্বর স্তব্ধ করতে পারেনি। পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেননি তাঁরা। বরং আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকেই সরব হয়েছেন, মানবতার এই কলঙ্ক নিয়ে। যৌথস্বর প্রতিষ্ঠা করতেই হাতে হাত রেখে তাঁরা এই তথ্যচিত্র বানানোর কাজ শুরু করেছিলেন। সেই স্বর অন্য মাত্রা পেল যৌথ প্রতিবাদে। দ্ব্যর্থহীনভাবেই তাঁরা জানিয়েছেন যে, এই রাজনৈতিক সংঘাত যে পথে সমাধান করা যেতে পারত, সেখানে অনেকাংশেই বাধা মার্কিন মুলুকের বিদেশনীতি। অর্থাৎ মার্কিন-সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি তাঁরা, অস্কার হাতে নেওয়ার পরেও। ঠিক যেমন ‘এমিলিয়া পেরিজ’ ছবির অভিনেত্রী জোয়ে সালদানা সাফ জানিয়েছেন, তিনি যে অভিবাসীর সন্তান, তা স্বীকার করতে তাঁর দ্বিধা নেই, এবং এই পরিচয়ে তিনি গর্বিত। ট্রাম্প শুনুন বা না-ই শুনুন, বিশ্ব বুঝেছে, তিনি প্রতিবাদের ভাষাই রেখে এসেছেন অস্কারের মঞ্চে।
:আরও শুনুন:
অস্কারজয়ী ‘নাটু নাটু’ অপছন্দ অনেকেরই, নেটদুনিয়ার সমালোচনা দিচ্ছে কীসের ইঙ্গিত?
সুতরাং ফিরে যাওয়া যাক গোড়ার প্রসঙ্গে। কৃতি নিয়ে আসে স্বীকৃতি। সম্মানিত হন কৃতী। তবে, তা কখনই আনুগত্যের দাসখত হতে পারে না। রাষ্ট্র মাত্রই অন্যায় করে বসে। তার প্রতিবাদও জরুরি। সে যেখানে, যে ঘটনাই হোক না কেন। কিন্তু বড় পুরস্কার বা রাষ্ট্রীয় সম্মাননা কি অনেক সময় প্রতিবাদী সত্তাকে গিলে ফেলতে পারে? পারে, তবে সেটাই সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়ায় না।
বাসেল আদরা, হামদান বাল্লাল, ইউভাল আব্রাহাম এবং র্যাচেল জোর- চার পরিচালকের যৌথস্বর বুঝিয়ে দিল, ভালো কাজের পুরস্কার, মন্দ কাজের প্রতিবাদে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, আজও।