যে শিব-কল্পনার সঙ্গে আমরা অভ্যস্ত, তার সঙ্গেই ওতপ্রোত হয়ে আছে নদী এবং সভ্যতা।মহাদেবের জটায় যে-গঙ্গার অধিষ্ঠান, সেই পুণ্য জলধারাই বাঁচিয়ে রেখেছে এই সভ্যতাকে। একদিন যেন সেই সভ্যতা মন্থন করতে করতেই একদিকে যেমন উঠে আসে অমৃত, অন্যদিকে গরল। যিনি জল দিয়ে এই সভ্যতায় প্রাণসঞ্চার করেছিলেন। সমস্ত বিষ ধারণ করে তিনি নীলকণ্ঠ হয়ে ওঠেন। সে বিষ আসলে মানুষের ইতিহাসেরই।
“নদীকে জিজ্ঞাসা করিতাম ‘তুমি কোথা হইতে আসিতেছ?’ নদী উত্তর করিত ‘মহাদেবের জটা হইতে।’ – আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা এই পঙক্তি বাঙালির কাছে প্রায় প্রবাদ হয়ে উঠেছে। এই লেখা আমাদের জানায়, যে শিব-কল্পনার সঙ্গে আমরা অভ্যস্ত, তার সঙ্গেই ওতপ্রোত হয়ে আছে নদী এবং সভ্যতা।
মহাদেবের জটায় যে-গঙ্গার অধিষ্ঠান, সেই পুণ্য জলধারাই বাঁচিয়ে রেখেছে এই সভ্যতাকে। আচার্য এর পরের লাইনেই লিখেছিলেন, ‘তখন ভগীরথের গঙ্গা আনয়ন বৃত্তান্ত স্মৃতিপথে উদিত হইত।’ মৃত সভ্যতাকে প্রাণ দিতেই গঙ্গার অবতরণ। এই রূপকের মধ্যেই যেন সভ্যতার বিস্তারের ইতিহাসও। গঙ্গার নেমে আসার প্রবল বেগ-ভার বইবে কে! অতএব মাথা পেতে দিলেন মহাদেব। ধারণ করলেন জলের তীব্র স্রোত। যে স্রোতে ভসে যেতে পারত সভ্যতার বীজ, তা হল নিয়ন্ত্রিত। তারপর গঙ্গাকে পথ দেখিয়ে আনলেন ভগীরথ। সভ্যতার ইতিহাস তো মানুষেরই। জল-ই সেই সভ্যতাকে প্রাণের সন্ধান দেয়। পৌরাণিক এই কাহিনি যেন সেই গোড়ার অনুষঙ্গই ধরিয়ে দেয়। আর আশ্চর্য যে, সভ্যতার সেই কল্পনা বা বীজের ইতিহাসে মিশে আছেন দেবাদিদেব মহাদেব। তিনিই যেন জল দিচ্ছেন এই সভ্যতাকে। যেখান থেকে মানুষের সভ্যতার সূত্রপাত। রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ মনে পড়তে পারে এই প্রসঙ্গে। সে অঞ্চলের নামও তো শিবতরাই। যখন যন্ত্রসভ্যতা প্রকৃতিকে নিজের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করছে, তখনকার সেই সংলাপ স্মরণ করার মতো- ‘তারা বিশ্বাস করতেই পারে না যে, দেবতা তাদের যে জল দিয়েছেন কোনও মানুষ তা বন্ধ করতে পারে।’ এই যে দেবতা, যিনি সভ্যতাকে জীবন ও জল দিয়েছেন তিনি আমাদের চিরন্তন কল্পনায় শিব-ই।
এই জলস্পর্শে সভ্যতা এগোয়। শস্যশ্যামলা হয়। মানুষের ইতিহাস গতি পায়। নানা বাঁকবদলের সামনে এসেও দাঁড়ায়। মানুষের ইতিহাস তো মানুষেরই তৈরি। একদিন যেন সেই সভ্যতা মন্থন করতে করতেই একদিকে যেমন উঠে আসে অমৃত, অন্যদিকে গরল। অমৃত কী? আমরা কল্পনা করতে পারি, তা মানুষের শাশ্বত বোধ। যা সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে। ভেদাভেদ, বিভাজন পেরিয়ে মানুষকে যা এক চিরন্তন বন্ধনে বেঁধে রাখতে পারে। রাজনীতির মানচিত্র মানুষকে ছোট ছোট সীমায় বেঁধে রাখে। তবে আমাদের প্রজ্ঞা তো জানায় যে, মানুষ অমৃতের সন্তান। তবে এই সভ্যতামন্থন নিষ্কণ্টক নয়। কেননা উঠে আসে গরলও। সে গরল ধারণ করে সভ্যতাকে বাঁচাবেন কে? এবারও এগিয়ে আসেন তিনিই, যিনি জল দিয়ে এই সভ্যতায় প্রাণসঞ্চার করেছিলেন। সমস্ত বিষ ধারণ করে তিনি নীলকণ্ঠ হয়ে ওঠেন। সে বিষ আসলে মানুষের ইতিহাসেরই। মনে পড়বে, ‘যুক্তি-তক্কো-গপ্পো’য় এসে ঋত্বিক ঘটক তাই স্বয়ং হয়ে উঠলেন নীলকণ্ঠ। সভ্যতার এই যেন বৃত্ত। জল থেকে যে সভ্যতা, সে সভ্যতাই বিষ উগরে দেয়। আর যিনি জল দেন সভ্যতাকে, তিনিই নীলকণ্ঠ হয়ে ওঠেন। সেই মহাপুরুষই শিব, পরম শিব। এটিই সভ্যতার চির সত্য। সেই সত্য, শিব আর সুন্দরের সাধনাই মানবতার চিরন্তন কথা।