কেষ্ট পেতে কষ্টের পথ আর কে হাঁটে! বানান ভুল একটা ছুতো মাত্র। আসলে বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের যত আবেগ, যত কথা, তত কাজ কোথায়! অথচ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হওয়ার কথাটুকু তো লেখা হয়েছিল বাংলাতেই। ভুলে কী আসে যায়! মেঘলা গুমোট অভ্যেস হয়ে এলে মাতৃভাষা দিবস শুধু আসে, চলেও যায়।
অলংকরণ: দীপঙ্কর ভৌমিক
তো বাংলা বানান ভুল দেখলে আপনি কী করবেন? ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেয়েছে মাতৃভাষা। নিঃসন্দেহে দারুণ প্রেস্টিজিয়াস ব্যাপার। সেই ভাষার অবমাননা দেখলে, কিছু তো একটা করা উচিত। বাসে, ট্রামে, রোডে, সাইনবোর্ডে কত বানান-ই তো ভুল থাকে। স্লেট থেকে গুগল ট্রানস্লেটে এসে বানানেরও মেটামরফোসিস। সে এই পোকা তো ওই মানুষ। এই রুমাল তো ওই বেড়াল। তা, হ-য-ব-র-ল এমন বেড়েছে যে পণ করেও বিজ্ঞাপন ঠিক করা যাচ্ছে না। এদিকে নাকি উড়ে যায় কোটি কোটি টাকা! এত টাকার বহর, আর জনমদুঃখী বাংলা ভাষা, তা কি একটু বানান-সচেতনতা আশা করতে পারে না। সুতরাং বাংলা বানান বা ভুল বাংলা দেখলে কিংবা শুনলে কিছু যে একটা করণীয়, তা একেবারেই অস্বীকার করা যায় না।
তা, কী কী করা যেতে পারে? প্রথমেই দারুণ রেগে ওঠা যেতে পারে। বিদ্যাসাগরের কসম! প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ, দেশভাগ পেরিয়ে এসেও বাংলা নিয়ে এমন কেন হেলাফেলা! অতএব বাংলা আমার তৃপ্ত শেষ চুমুক বলে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বাংলায় হাহাকার দস্তুর ভেবে আপনি ভীষণই তেতে উঠবেন। এই বাংলার কিচ্ছু যে হবে না, সে ব্যাপারে আরও একবার নিশ্চিত হয়েই যাবতীয় ক্রোধ। আর হবেই বা কী করে! বাংলায় আছে বা কী! কাজে-কামে সকলকেই যেতে হয় বিদেশ-বিভুঁইয়ে। নিদেন অন্য প্রদেশে। তা যস্মিন দেশে যদাচার! সেখানকার ভাষা তো ছেলেমেয়েদের শিখতেই হবে। নইলে স্কুলের দরজা বন্ধ। আর সবার উপরে উত্তম-সুচিত্রা নেই, আছে ইংরেজি। নেসফিল্ড গুলে না খেলে একেবারে ফিল্ডে এসে নামতে হবে। এই বাজারে কে আর সে রিস্ক নেয়! এমনিতেই প্রাথমিকে ইংরেজি না শিখিয়ে কারা যেন কতগুলো প্রজন্মের ইহকাল-পরকাল সব ঝরঝরে করে দিয়েছে। সে অন্য আমলের কথা। পুরনো আমলে এত আমল দিলে চলে না। আগেও লোকে ইংরেজি শিখত। এখনও শেখে। তফাৎ শুধু বাংলা ভাষায়। আগে ইংরেজি শেখায় বাংলায় কোনও বাঁধা পড়ত না। এখন বাংলা শেখা শিকেয়। কোনক্রমে কথাটুকু বলতে পারএই হল। পড়া-লেখা দূরতম দ্বীপ, তার আবার বানান ভুল! এই অবস্থায়, অর্থাৎ কর্মসংস্থানের যখন এই হাল, তখন বাংলার আর হবে কী করে। বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে যা যা এককালে হত, এখন আর তা হয় না। যাঁদের হয়, তাঁদের হয়। তবে দিনকাল বদলেছে। সোজা কথা বাংলা বলে, বাংলা লিখে কাজের সুযোগ হাতেগোনা। তাহলে সেই ভাষার আর গুরুত্ব থাকে কী করে!
অতএব রেগে ওঠা সঙ্গত। দ্বিতীয় কাজ হল, সেই রাগের প্রকাশ। বাংলা বানান কেন ভুল হচ্ছে তা নিয়ে তো আর রোড-মিটিং হয় না। ঝান্ডা, পতাকা নেই। বানান ভুল নিয়ে বিধানসভায়, সংসদে অধিবেশন বসে নাকি! তা বলে আবার রাগের চোটে সবকিছু বয়কট করাও যায় না। খোদ বইমেলাতেই কত জায়গায় কত বানান ভুল! কী আর করবে সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালি! শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা। অতএব অকূলের গতি ভরসা সোশ্যাল মিডিয়া। বাংলা নিয়ে যে এত অবহেলা, ভালবাসা মোটেও নেই, তা নিয়ে জব্বর দু-চার কলম লিখে ফেলা যায়। তাতে বিপুল প্রতিক্রিয়া মিলবে। লাভ-লাইকে শান্তিপুর ডুবুডুবু নদে ভেসে যায়। এর মধ্যেই কে একজন যেন চালের মধ্যে কাঁকর বাছতে বসবে। ওই যা, একখানা টাইপো রয়ে গেল যে! তাতে কী! এডিট আর ক্রেডিট নিয়ে চলে যাবে না!
তারপর সে-পোস্ট কালের নিয়মে তলিয়ে যাবে। বছরখানেক বাদে মেমরি-লোকালে আবার বাংলা ভাষার কামরা ফিরে এলে মনে হবে, বলে কী লাভ! কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে। অতএব ভুল বানান, ভুল বাংলা একদিন চোখ সওয়া হয়ে যাবে। ‘কেন কী’ কারণ শব্দটা আমাদের মনেই পড়বে না। ভাষা নাকি আশ্রয়। ঘরের মতো। তা ঘর বদলে গেলে কি চিন্তা-ভাবনা করা যায়! ভাষার আশ্রয় বদলে গেলে চিন্তার খুঁটিও নড়বড়ে। আর মাটি আলগা হলে যায় হয়। এদিক সেদিক থেকে কত বেনোজল যে ঢুকে পড়ে। অন্য ভাষার সংস্কৃতি এসে আমাদের একেবারে ‘ধুয়ে দিলে’ মনে পড়ে কী জ্বালা, এ তো সেই ‘ধো ডালা’! কিন্তু ততক্ষণে সব গা-সওয়া, আর চোখ-সওয়া। শয়ে শয়ে ভুল সয়ে যাওয়ার ফলে আবার গা চিড়বিড় করে ওঠে। সেই রাগ। রেগে ওঠাই তো প্রাথমিক কর্তব্য। অতএব যত দোষ আগ্রাসন ঘোষ। অন্য ভাষার দখলদারির রাজনীতি তো চলছেই। তার উপর দোষ চাপিয়ে দিলে নিজের কাঁধের ভার খানিক লাঘব হয় বইকি! এসব তো চলছে, চলবেই। কত আর রেগে থাকা যায়! মাথার উপর আছেন রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম। মাদার-ফাদার ল্যাঙ্গোয়েজকে অতএব সোনার ঐতিহ্যে বাঁধিয়ে বড়জোর আক্ষেপ করা যেতে পারে, আছে তো পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ। বাঙালিয়ানার ষোলআনা দিন চারেকে উসুল করে নিলেই হবে। বাকি ভুলের ওঠাপড়া তাহলে আর গায়ে লাগে না। যত ধানে যত চালই হোক, আগ্রাসনের কূটচালে কি আর বাঙালিকে মাত দেওয়া যায়!
আর অভিধান? তার সঙ্গে দেখা হয় না বহুদিন। নেই মুখোমুখি বসিবার অবসর। উপহারের তালিকায় থাকে না অভিধান। বইমেলার বেস্টসেলারে নেই। অথচ ছাপা হয়। নতুন সংস্করণ বেরোয়। কিন্তু কেষ্ট পেতে কষ্টের পথ আর কে হাঁটে! বানান ভুল একটা ছুতো মাত্র। আসলে বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের যত আবেগ, যত কথা, তত কাজ কোথায়! অথচ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হওয়ার কথাটুকু তো লেখা হয়েছিল বাংলাতেই। ভুলে কী আসে যায়! মেঘলা গুমোট অভ্যেস হয়ে এলে মাতৃভাষা দিবস শুধু আসে, চলেও যায়।