মিথ্যার প্রচার বা প্রোপাগান্ডা থাকে। সময়ের নিয়মেই থাকে। তার প্রতিরোধ সম্ভব যদি উঠে আসে সঠিক তথ্য। প্রসঙ্গত মনে করা যেতে পারে যে, ‘মেইন ক্যাম্ফ’-এর সটীক সংস্করণ পরে প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে ইতিহাসের মিথ্যেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছিল। সাধারণভাবে ইতিহাস-চর্চাকেও এই পরিসরেই পৌঁছতে হবে। নয়তো মানুষ সেই ইতিহাসই বিশ্বাস করবে, যা সে বিশ্বাস করতে চায়। এতে রাজনীতির লাভ হতে পারে, তবে ষোলআনা লোকসান ইতিহাস এবং মানুষের।
‘ছাবা’ সিনেমা নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক নতুন করে এক চর্চার দিক খুলে দিয়েছে। ইতিহাস-চর্চা কি আদৌ সিনেমানির্ভর হওয়া উচিত? বিশেষত সেই সময়ে, যখন ইতিহাসের রাজনৈতিকীকরণ একটি মুখ্য সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে বহু ক্ষেত্রে। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে বিস্তর আলোচনা।
‘ছাবা’ সিনেমায় কী ইতিহাস দেখানো হয়েছে, আর কী দেখানো উচিত ছিল, সে-বিতর্ক নাহয় সরিয়েই রাখা গেল। তবে, এ কথা ঠিক যে, সাম্প্রতিক সময়ে ইতিহাসকে রাজনীতির রং-এ দেখার প্রবণতা বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে, ইতিহাসকে এক চোখে দেখার প্রক্রিয়াও। সিনেমার শক্তি আছে জনগণের মনে দ্রুত প্রভাব ফেলার। কথায় বলে, একটা ছবি হাজার কথার সমান। ভারতীয় জনমানসে তাই সিনেমার প্রভাব ও গুরুত্ব অন্য মাত্রার। সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়েই ইতিহাসকে দেখানোর চেষ্টা চলে। এই পদ্ধতি নতুন নয়। সময় বদলায়। বদলায় রাজনৈতিক শাসনের কর্তৃত্ব। আর সেই পথ ধরেই চলে ইতিহাসকে দেখার পদ্ধতি। সাম্প্রতিক সময়েও এই বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছে। একের পর এক ছবি হয়েছে, যা দেখে একপক্ষ বলেছে যে, ইতিহাসের বিকৃতি হচ্ছে। অন্য পক্ষের সাফাই যে, চাপা দেওয়া ইতিহাস তুলে আনা হচ্ছে। এই বিতর্ক থেকেই ইতিহাস পাঠের মূল পদ্ধতিটি বুঝে নেওয়া যায় নতুন করে। ইতিহাস পাথর নয়। তার মধ্যে নানাবিধ চলমানতা। আর তা মূলত দেখার ফারাকের জন্যই তৈরি হয়। অর্থাৎ সত্যকে কীভাবে দেখা হচ্ছে, তা অনেকটাই রাজনৈতিক দৃষ্টির উপর নির্ভর করে। ফলত ইতিহাসের রাজনৈতিকীকরণ হতেই থাকে। কিছু দেখানোও যেমন রাজনৈতিক, না-দেখানোও একই ভাবে রাজনৈতিক। অর্থাৎ সত্যকে বা ইতিহাসকে দেখতে হয় বহুকৌণিক দিক থেকেই। তাহলেই বোঝা সম্ভব যে, কোন উদ্দেশ্য সাধনে ইতিহাসের কোন অংশকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সিনেমা কোনও একটি বিশেষ দৃষ্টি তুলে ধরতে পারে। অভিনেতার স্টারডমের দৌলতে তা মানুষের মনে গেঁথেও যেতে পারে। কিন্তু সিনেমাকেই শাশ্বত ইতিহাস হিসাবে কেন ধরে নেবেন মানুষ? সম্ভবত এর পিছনে আছে ইতিহাসচর্চার গলদ। ইতিহাসের এই যে ভিন্নপাঠ, এবং ভিন্ন দৃষ্টির পথ অবলম্বন কর সত্যকে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা, তা যতখানি বিদ্যায়তনিক স্তরে সীমাবদ্ধ, ততটা বাইরে নয়। তা হওয়া খানিক স্বাভাবিক বটে। যাঁরা একটি বিষয়ে গভীর চর্চা করেন, তাঁরাই সেই সমুদ্রে ডুব দিতে পারেন। কিন্তু যখন রাজনীতি ইতিহাসকে বিকৃত বা কেটেছেঁটে দেখানোর চেষ্টা করে, তখন ইতিহাসকেও বোধহয় সীমা পেরিয়ে সামনে আসা দরকার। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরেই যদি সে ব্যবস্থা থাকে, তাহলে ইতিহাসবিকৃতি নিয়ে এই তর্ক আর ঘনিয়ে ওঠে না। মিথ্যার প্রচার বা প্রোপাগান্ডা থাকে। সময়ের নিয়মেই থাকে। তার প্রতিরোধ সম্ভব যদি উঠে আসে সঠিক তথ্য। প্রসঙ্গত মনে করা যেতে পারে যে, ‘মেইন ক্যাম্ফ’-এর সটীক সংস্করণ পরে প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে ইতিহাসের মিথ্যেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছিল। সাধারণভাবে ইতিহাস-চর্চাকেও এই পরিসরেই পৌঁছতে হবে। নয়তো মানুষ সেই ইতিহাসই বিশ্বাস করবে, যা সে বিশ্বাস করতে চায়। এতে রাজনীতির লাভ হতে পারে, তবে ষোলআনা লোকসান ইতিহাস এবং মানুষের। ‘ছাবা’ সিনেমা নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক যেন সেই ভাবনার দরজাটাই খুলে দিল নতুন করে।