এই প্রবণতা আমাদের সামাজিক সম্পর্কের বুননও নষ্ট করছে। মানুষের সঙ্গে মানুষে যে সম্পর্ক তা তাৎক্ষণিক নয়। প্রতিক্রিয়া নির্ভর ব্যবহারের প্রবণতা সেই সম্পর্কের গভীরতাকেই আমল দিচ্ছে না। ফলত, বিশ্বাস বা পারস্পরিক নির্ভরতার জায়গাগুলো নড়ে যাচ্ছে। সামগ্রিক ভাবে তা গোটা সমাজের জন্যই অস্বস্তিকর এবং অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠছে।
দরজায় অতিথি। এদিকে অতিথি সৎকারের জরুরি জিনিসটিই আনা হয়নি। উপায় কী! মনে করে শুধু অর্ডারটুকু প্লেস করে দিলেই হল। চোখের নিমেষে জিনিস এসে বাড়িতে হাজির। আর তাতেই তৃপ্তির হাসি পরিবার-পরিজনের মুখে। ক্যুইক-সার্ভিসের এই বিজ্ঞাপন সকলেরই চেনা। এই সার্ভিস আসলে আমাদের তাৎক্ষণিক তৃপ্তিকেই ইন্ধন জোগায়। চলতি জীবনশৈলীতে এই অভ্যাস মোটামুটি চারিয়ে গেছে আমাদের রক্তে। কিন্তু তাতে কি বদলে যাচ্ছি আমরা? বদলে যাচ্ছে আমাদের সম্পর্কও! এই ভাবনার অবকাশ তৈরি হয়েছে বইকি।
কিছুদিন আগে সাহিত্যিক গীতাঞ্জলি শ্রী এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রিত আমাদের জীবন এই ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশনে অভ্যস্ত করে তুলেছে। ফলত, সকলের কাছেই আমাদের চাওয়া তাৎক্ষণিক। কেউ কেউ তা মেটাত পারেন। যেমন, চিকিৎসক রোগ সারাতে পারেন। ইঞ্জিনিয়ার ব্রিজ তৈরি করে দিতে পারেন। কিন্তু এমন আশু কোনও তাৎক্ষণিক প্রতিকার বিধান একজন সাহিত্যিক তো দিতে পারেন না। অথচ আমাদের প্রত্যাশার ঝোঁক যদি সেদিকেই হয়, তাহলে সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটাই বদলে যাবে। এবং যাচ্ছেও। সাহিত্যের প্রসঙ্গেই ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশনের বিপদ চিহ্নিত করেছিলেন বুকারজয়ী সাহিত্যিক।
তবে শুধু সাহিত্য পরিসরে নয়, এই অভ্যাসের কাঁটা আমাদের রোজকার জীবনেও। চাওয়া মাত্র পাওয়া। বা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার দরুন যে আনন্দ বা তৃপ্তি আমাদের কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠছে প্রায় সর্বক্ষেত্রে, তা আমাদের ভুলিয়ে দিচ্ছে একটি জিনিস। তা হল, সব কিছু এমন তাৎক্ষণিক পাওয়ার জিনিস নয়। কোনও একটি বিষয় বা কোনও সমস্যা এমন জটিল বা বহুমাত্রিক হতে পারে যে, তার জন্য সময় দিতে হয়। যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করতে হয়। এমং একটি জটিল সমস্যাকে ধৈর্য ধরেই সমাধান করতে হয়। ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশনের মোহ আমাদের থেকে কেড়ে নিচ্ছে এই ধৈর্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকেই প্রভাবিত করছে এই প্রবণতা। দ্রুত ফলাফল পাওয়ার ইচ্ছে, কোনও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার দিকে এগোতে বাধা দিচ্ছে। ফলত জটিল বা বহুমাত্রিকতায় চিন্তার জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ক। একটি গড় অভ্যাসেই তা কাজ করে চলেছে।
শুধু তাই-ই নয়, এই প্রবণতা আমাদের সামাজিক সম্পর্কের বুননও নষ্ট করছে। মানুষের সঙ্গে মানুষে যে সম্পর্ক তা তাৎক্ষণিক নয়। প্রতিক্রিয়া নির্ভর ব্যবহারের প্রবণতা সেই সম্পর্কের গভীরতাকেই আমল দিচ্ছে না। ফলত, বিশ্বাস বা পারস্পরিক নির্ভরতার জায়গাগুলো নড়ে যাচ্ছে। সামগ্রিক ভাবে তা গোটা সমাজের জন্যই অস্বস্তিকর এবং অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠছে। এর প্রভাব পড়ছে ব্যক্তি মানুষের উপরেও। বাড়ছে উদ্বেগ। মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। আদতে এই অভ্যাস আমাদের ভাবনাচিন্তার পদ্ধতিটিকেই ঘুলিয়ে দিচ্ছে। ফলত, একজন মানুষের নিজের চিন্তা, এবং সমাজের সঙ্গে সেই চিন্তার সমন্বয়ের জায়গাটিই আসলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই ক্ষতি কিন্তু তাৎক্ষণিক নয়। মানুষকে তা বদলে দিচ্ছে, বহুকালের জন্যই। আর তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, এই প্রবণতাকে প্রতিরোধ করা। দ্রুত ফলাফল নয়, বরং পদ্ধতির উপর জোর দেওয়া। দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনার অভ্যাসই এই মোহ থেকে মুক্ত করতে পারে গোটা সমাজকে। তবে, সে দায়ভার প্রত্যেক ব্যক্তি মানুষেরই।