তারা ঘটক। প্রেমের ঋত্বিক। দূত কিংবা দূতি। পদাবলি তাঁদের ছাড়া অসম্পূর্ণ। বৃন্দাবন কদমের গন্ধে নেশা-নেশা। তবে যুগলমিলনের পর তাঁদের আর কে মনে রাখে! প্রেমের যাবতীয় স্থানীয় সংবাদে তাঁরাই বিশেষ সংবাদদাতা। চিঠি চালাচালিতে বিশ্বস্ত। কিশোরী ফ্রক কিংবা ডাকাবুকো হাফপ্যান্ট। তারপর একদিন দাদা-দিদি হাত ধরে সিঁড়িতেই বসে পড়ে। আর বেচারা ঘটক কাটা ঘুড়ি। আটকে পড়ে স্মৃতির শুকনো ডালে। আজ প্রেমের দিনে তাদেরই ফিরে দেখার পালা।
প্রেমের ঘটকালি নিয়ে লিখলেন, মোহনা মজুমদার।
ছোটোবেলা থেকেই বাংলায় টুকটাক গল্প, ছড়া লিখতে পারতুম বলে বন্ধুরা মজা করে ‘কবিতা পিসি’ বলে ডাকতো। ফলে যার যখন যা শায়রি লেখানোর দরকার হত, দায়িত্ব এই শর্মার! বদলে মিলত ভালো টিফিনের ভাগ। আমিও মহানন্দে খাতা পেন নিয়ে খসখস করে লিখে ফেলতুম, ‘তোমার মুখের হাসি/ চাঁদের আলোর রাশি/ভিজিয়ে দেয় যখন/ মন বলে তুমি/থেকে যাও সর্বক্ষণ’ ইত্যাদি নানা ছেলেমানুষি গোছের লেখা ।
মফস্বলে বেড়ে ওঠা আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের কাছে প্রেম বলতে ছিল দূর থেকে দেখে মিটিমিটি হাসা, কিংবা পাশের পাড়ার কোনও গলির পথে পথে দু’কলি ঘোরাফেরা, আবার ভয়ও থাকত যদি চেনা কেউ দেখে বাবা-মাকে গিয়ে নালিশ করে দেয়! যাই হোক, তো আমাদের ছিল গার্লস স্কুল। আমাদের ক্লাসের বান্ধবী শিল্পার মা, সীমিতা দিদিমণি ছিলেন আমাদের স্কুলের অঙ্কের শিক্ষিকা। আমরা ক্লাসের কয়েকজন ওঁর কাছে টিউশন পড়তে যেতাম। আর পাশের স্কুলটাই ছিল বয়েজ স্কুল। ওই স্কুল থেকেও কয়েকজন বন্ধু আসত দিদিমণির কাছে টিউশন পড়তে। তখন আমরা ক্লাস ইলেভেন। তো বিল্টুর পছন্দ হয়ে গেল শিল্পাকে। এদিকে সে দিদিমণির মেয়ে। ফলে শিল্পাকে গিয়ে সরাসরি প্রস্তাব দেওয়ার সাহসও তার বুকে কুলায় না। অন্যান্য বন্ধুরাও যে যার মতো হাত তুলে দিল আর ডাক পড়ল আমার।
‘একটা লাইন করে দে ভাই’ – বলে প্রায় হাতে পায়ে ধরার উপক্রম বিল্টুর। অন্যরাও ধোঁয়া তুলে বলে, ‘করে দে ভাই, তুই হলি আমাদের কবিতা পিসি কাম ঘটক লিডার, তুই না পারলে কে পারবে বল্!’ ওমনি আমারও যেন গর্বে বুকের ছাতি দ্বিগুণ হয়ে গেল। টিউশনের পর গলির মোড়ে শুরু হতো টিউশন ফেরত আড্ডা। আবার ভয়ও লাগত যদি দিদিমণি কোনোভাবে জানতে পারেন যে আমি এসবের পেছনে আছি, তাহলে কেলেঙ্কারি হবে, মাকে বলে দিলে পুরো কেস খাব। এদিকে সামনেই ভ্যালেন্টাইন্স ডে। যাই হোক তখনকার দিনে তো ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ এসব ছিল না তাই খুব মিষ্টি করে একটা চিঠি লিখে দিলাম বিল্টুকে ‘ প্রিয় শিল্পা…’ ।
পড়ে শোনালাম আমাদের আড্ডায়। সবার তো হেব্বি পছন্দ হলো। পরের দিন স্কুলে দেখা হতেই পাকড়াও করলাম ওকে। ‘শোন তোকে যে বিল্টুর কথা বলেছিলাম, বললি না তো কেমন লাগে ওকে?’
উত্তরে ও মলিন গলায় বলল, ‘না রে এসব কিছু করব না, মা জানতে পারলে কেটে রেখে দেবে।’
‘আরে তুই ভয় পাস না , ম্যায় হুঁ না, এই নে ও একটা চিঠির পাঠিয়েছে, পড়ে জানাবি আমায়, আমি ওকে জানিয়ে দেব, আর চিঠিটা সাবধানে রাখবি , দিদিমণির হাতে যেন না পড়ে।’
বিল্টুকে যে ওর পছন্দ হয়েছে সে ওর চোখমুখ দেখেই আমি বুঝেছিলাম। তবু ওর উত্তরের অপেক্ষা তো করতেই হবে। পরদিন যথারীতি শিল্পা স্কুলে এসে একটা চিঠি আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘ওকে দিয়ে দিস’। অন্যের চিঠি পড়তে নেই, তাই ওটা গিয়ে বিল্টুর হাতেই দিলাম। চিঠির প্রথম পর্বের আদানপ্রদানের শেষে যা দাঁড়াল তা হল , ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে ওরা মিট করবে। তো কীভাবে হবে? সীমিতা দিদিমণিকেই বা কী বলে বেরোবে ও? ভাবতে ভাবতে একটা আইডিয়া মাথায় এল। ঠিক হল বন্ধুরা সবাই মিলে বইমেলা যাওয়া হবে। সবাই যে যার বাড়িতে জানিয়ে দিল , প্রথমে একটু নিমরাজি থাকলেও অন্যরা যাচ্ছে শুনে সবার মা-বাবাই মোটামুটি রাজি হলেন। যে যার সাধ্যমতো যতটুকু টাকা বাড়ি থেকে জোগাড় করতে পেরেছিলাম, সবাই এসে এক জায়গায় জমা করা হল। কত পরিকল্পনা, কীভাবে যাব, কখন বেরোবো ইত্যাদি। সে অপার আনন্দ যেন ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
মেলায় পৌঁছে বিল্টু-শিল্পা নিজেদের মতো বেছে নিয়েছিল কিছুটা সময়। প্রেম জিনিসটাই বোধহয় এমন, কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে নিজের খেয়ালে বয়ে চলে তরঙ্গের মতো। তারপর বয়ে গিয়েছে অনেকটা সময়। অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে বিল্টু শিল্পাও এখন সুখী দাম্পত্য জীবনে একে অপরের সঙ্গী। স্মৃতির পাতায় এমন কত গল্প থাকে , ঘটনা থাকে যা চিরকালের জন্য দাগ কেটে যায় মনের আড়ালে, এটাও বোধহয় তেমনই একটা মনে রয়ে যাওয়া কৈশোর স্মৃতি ।