তারা ঘটক। প্রেমের ঋত্বিক। দূত কিংবা দূতি। পদাবলি তাঁদের ছাড়া অসম্পূর্ণ। বৃন্দাবন কদমের গন্ধে নেশা-নেশা। তবে যুগলমিলনের পর তাঁদের আর কে মনে রাখে! প্রেমের যাবতীয় স্থানীয় সংবাদে তাঁরাই বিশেষ সংবাদদাতা। চিঠি চালাচালিতে বিশ্বস্ত। কিশোরী ফ্রক কিংবা ডাকাবুকো হাফপ্যান্ট। তারপর একদিন দাদা-দিদি হাত ধরে সিঁড়িতেই বসে পড়ে। আর বেচারা ঘটক কাটা ঘুড়ি। আটকে পড়ে স্মৃতির শুকনো ডালে। আজ প্রেমের দিনে তাদেরই ফিরে দেখার পালা।
প্রেমের ঘটকালি নিয়ে লিখলেন, সংগীতা দাস।
তখন বঙ্গের ঋতু এমন তিন নম্বর প্রেমিকের মত আনপ্রেডিক্টেবল ছিল না। গ্রীষ্মের শুরুতে কালবৈশাখী হতো, শীতে ঘাসের উপর শিশির জমত আর বৃষ্টিতে পারফেক্ট ব্যাঙের ডাক শোনা যেত। যে বয়সে ভিকো টারমারিকের মোহে না পড়ে উপায় নেই, সেই বয়সে গরমের ছুটির বিকেলে ফুরফুরে হাওয়ায় চারদিকের উড়ে বেড়াত ট্যালকম পাউডারের মায়া মায়া গন্ধ। সে সময়ে দেখা সেই ছেলেটিকে। অপাপবিদ্ধ চোখ, ছিপছিপে শ্যামলা মুখে দুঃখী দুঃখী ভাব। আর কে না জানে কচি বয়সে (এবং বুড়ো বয়সেও) মেয়েরা একাধারে ‘পুরুষসিঙ্গি’ অথচ স্বভাবদুঃখী দেখলেই প্রেমে পড়ে যায়? তা, অমন প্রেম জন্মাল মনের ভিতর। সবসময় একটা দেখি দেখি ভাব, অথচ দেখলে এড়িয়ে যাওয়ার ভান করে গলির মধ্যে ছুট দেওয়া। এক গাদা সমবয়স্ক অথচ অসমমনস্ক সখি জুটেছে বটে, তবে হৃদয়ের সে ধড়ফড়ানি গোপন রাখাই একমাত্র অভীষ্ট তখন।
এক মনোরম সন্ধ্যায়, টিমটিমিয়ে জ্বলে উঠছে মুদি দোকান, চা গুমটি, সাইকেল গ্যারেজ। সে দেখি আমারই পথের মাঝে দাঁড়িয়ে। দেখে তো হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে, তার উপর দেখি, আমাকেই ডাকছে। একটাও শব্দ মনে পড়ছে না, অথচ পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে হলো। সে ছেলে ফস করে একটা ফুলছাপ খাম বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। দুম করে মরে টরে যাব কি না ভাবছি, সে মিষ্টি হেসে বলল, ‘এইটা পাপিয়াকে দিয়ে দিস তো!’ মনের ভিতরটা তখন ট্রয় নগরীর যুদ্ধের আগের কাঠের ঘোড়া। ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে বিধ্বংসী সব কথা, কিন্তু চিঠি নিতে হল। পাপিয়াকে দিতেও হল তার বাড়ির উঠোনে গিয়ে, গোপনে। সে দেখি খুব অবহেলায় খুলে পড়ল আর মুখটা কেমন বেজার করে বলল, আবার চিঠি লেখার কী হল? আমি তো এখনও হ্যাঁ বলিনি! তারপর দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলল নর্দমার কোনায়। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকের পাঁজরও ছুড়ে ফেলল কয়েকটা। ওই হল শুরু।
রোজ আসতে লাগল চিঠি বা দেখা হওয়ার গোপন বার্তা। কেন যে আমাকেই ওরা বেছে নিয়েছিল বিশ্বস্ত বার্তাবাহকের নামে, তা জানি না। কেবল চিঠি বওয়ার কাজ নয়, গলিঘুঁজি টো-টো করে বেড়ানোর সুবাদে, নিভৃত স্থান বেছে দেওয়া এবং তাদের ঘনিষ্ঠ আলাপের সুযোগ দিয়ে কড়া পাহারার চোখ দিয়ে এদিক ওদিক দেখাও ভাগ্যে ছিল। তা, দেখতে দেখতে কি আর ওই ঘন ছায়াদুটিতে চোখ পড়ত না? আর পড়লে কি বুকের ভিতর হা-হা করে উঠত না? কিন্তু ওরা ততদিনে আমাকে বলেছে যে ওদের আগামী দ্বৈত জীবনের আমিই নাকি নৌকাবাহক, তাতে করে জলে বৈঠার ঘা মেরে যাওয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না। তবে প্রতিবার যে খুশি হয়ে এ কাজ করছিলাম না, তা বলাই বাহুল্য। যাকে দেখতে পেলে ফুরফুরে হয়ে যেত মন, তাকেই না দেখার জন্য নিত্য নতুন পথ খুঁজে বের করতাম।
একদিন কিন্তু আর পালাতে পারলাম না। সে ছেলে দেখি একমুখ দাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গলির ওপারে। মায়া হলো খুব। পাপিয়াকে আমি ঢের চিনি। সে যে একসময় ফসকে যাবে, তা নিশ্চিত জানতাম। তবু, কষ্ট হল। ভাবলাম, যাকে ভালো লাগে, তার ভালোলাগাটা থাকুক না হয়! কাছে গিয়ে হাত পেতে বললাম, ‘চিঠি দাও, দিয়ে দেব।’ সে ছেলে এক বুক নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘নেই রে। রিলেশন ভেঙে গেছে এক হপ্তা হল! তুই ভালো আছিস? কতদিন দেখি না যে?’
তাকে আমি কী করে বোঝাই, না দেখানোর জন্য কত পথ আমি বদলেছি। নইলে সে একদিন হয়তো আমার মনের ভিতরটাই দেখে…