রোস্টিং পশ্চিমের দেশে যেভাবে সম্ভব, এখানে তা হওয়ার নয়। আবার সবদিক রক্ষা করেও কমেডি হয় না। ফলত এই জায়গায় যেন এক সরু সুতোর উপর দিয়েই হাঁটছেন কমেডিয়ানরা। তাতে বিতর্ক কখনও বাধছে, তার প্রতিকারও মতামত জানিয়েই সম্ভব। তবে রোস্ট কালচারের প্রতিবাদে ক্যানসেল কালচার অনুঘটক হয়ে উঠতে পারে কি? এ প্রশ্নও কিন্তু জরুরি হয়েই থাকল।
রোস্টের ঘোস্ট এখন নেটদুনিয়ায়। শ্লীল-অশ্লীলের তর্ক জোরদার। রণবীর এলাহবাদিয়ার একটি মন্তব্যই যেন যাবতীয় সমালোচনার ঢাকনা খুলে দিয়েছে। আর তার সঙ্গেই মাথাচাড়া দিয়েছে নানা প্রশ্ন। আর এর জেরেই গুজরাটে বাতিল হয়েছে ‘ইন্ডিয়াজ গট লেটেন্ট’-এর শো। অর্থাৎ এবার ডার্ক কমেডির জেরে পেশাগত ক্ষতির মুখে পড়লেন সময় রায়না। যাঁর অনুষ্ঠানে এসেই বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন জনপ্রিয় পডকাস্টার রণবীর। আগামী এপ্রিলে সুরাট, আহমেদাবাদ, বদোদরায় এই অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। আপাতত আর তা হচ্ছে না। অনলাইনে টিকিট-ও মিলছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পক্ষ থেকেই এই অনুষ্ঠান বাতিলের কথা জানিয়ে, গুজরাটের দর্শকদের ধন্যবাদও জানানো হয়েছে।
বীর দাস থেকে শুরু করে সময় রায়না। দেখা যাচ্ছে, গত বছর পাঁচেকে ভারতীয় কমেডির ধারা যেমন বদলেছে; তেমনই তা মাঝেমধ্যেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বর্তমানে যে কমেডি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তা কেবল কৌতুক নয়। সেখানে রাজনীতি-সংস্কৃতির মিশেলে এবমন এক ধরনের কটাক্ষ বা খোঁচা থাকছে, যা একই সঙ্গে জনপ্রিয় ও বিতর্কিত। কখনও রাষ্ট্র এই কমেডিয়ানদের উপর খড়্গহস্ত হচ্ছে। কখনও আবার সাধারণ মানুষ তাঁদের অনাস্থা জানাচ্ছেন। মোটকথা, কমেডিয়ানরা যে বর্তমান ভারতবর্ষে ছুরির উপর দিয়েই হাঁটছেন তা বলা যায়। যে রোস্ট কালচার নিয়ে এত হইচই, তা আদতে নতুন কিছু নয়। পশ্চিমের দেশে তা জনপ্রিয় বটে। বিশ্বায়নের দৌলতে গোটা বিশ্বই এসে মিশেছে ঘরের চৌকাঠে। ফলত নানা ধরনের কন্টেন্টের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠছেন দর্শক। নতুন ধরনের কন্টেন্ট তৈরি করার ঝোঁকও বেড়েছে। এই প্রেক্ষিতেই দেখা গেল, সাম্প্রতিক অতীতে নেটিদুনিয়ায় ভরসা রেখে উঠে এসেছেন একদল কমেডিয়ান। অতীতে রাজু শ্রীবাস্তবে বা জনি লিভারের মতো কৌতুকশিল্পীদের উপাস্থাপনা থেকে তাঁদের উপাস্থাপনার ধরন একেবারেই আলাদা। এই ধরনের কমেডির দর্শকও আলাদা। ফলত যৌনতা থকে শুরু করে অন্যান্য নানা বিষয়ে একটু খোলামেলা কথাই চলে এল কমেডিতে।
আরও শুনুন: নেটদুনিয়া ভালগার-আগার, তবে কেন যত পচা ডিম রণবীর এলাহবাদিয়ার মুখে?
এদিকে চাহিদা যত বাড়ছে, কালচার ইন্ডাস্ট্রির শর্ত মেনেই কন্টেন্ট আরও বেশি তৈরি হচ্ছে। দর্শক টানতে তা দুঃসাহসী হওয়ারও চেষ্টা করেছে। গোলমালের সূত্রপাত সম্ভবত সেখানেই। ভারতীয় মানস একমাত্রিক নয়। তা বেশ জটিল এক সংস্থান। সেখানে একদিকে যেমন গোঁড়ামি, অন্যদিকে আছে প্রগতিশীলতা। একদিকে যেমন আধুনিকের দিকে ঝোঁক, অন্যদিকে তেমন সনাতনের প্রতি টান। এর উপর আছে নানা বয়সের মূল্যবোধের ফারাক, গ্রহণযোগ্যতার তর-তম পার্থক্য। ভাষা ও প্রদেশ বদলে গেলে মানসিকতার হেরফের চোখে পড়া অবশ্যম্ভাবী। ফলত নেটদুনিয়া বলতে যদি এক সুতোয় বাঁধা দর্শকের কথা ভাবা হয়, তাহলে ভুলই হয়ে যায়। এই যে নানারকম পার্থক্য মিলেমিশে দর্শকের গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, সেখানেই কখনও কোনও কন্টেন্টে ভাবাবেগে আঘাত করছে। রণবীর যে মন্তব্য করেছেন, তা ওই দুঃসাহসী হওয়ারই চেষ্টা। তিনি যে দর্শকের কথা ভেবে বলেছিলেন, আর যে দর্শক তা দেখেছেন তার তালমিল হয়নি। ফলত গোলমাল যা বাধার বেধেছে। তর্কের ঝড় বয়ে গিয়েছে নেটদুনিয়ায়।
তবে, সেখানেই ব্যাপারটা থেমে থাকল না। এবার এই ঘটনার জেরেই অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে গেল একজন কমেডিয়ানের। যিনি এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। এখানেই উঠল আর এক প্রশ্ন। একটি বিষয় যদি ভালো না লাগে তা নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা অবশ্যই চলতে পারে। সেই মতামত নিশ্চিতই কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের নতুন করে ভাবাবে। কিন্তু তা যদি আবার বাতিল-সংস্কৃতিকে ইন্ধন দেয়, তাহলে গোলমাল অন্য মাত্রা পায়। সাম্প্রতিক অতীতে এই বাতিল সংস্কৃতি যেন এক রকমের রাজনৈতিক রূপও নিয়েছে। যা কিছু মতাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে সেই বিষয়টিকেই বাতিল করে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। দেশের তাবড় তারকারা এর ভুক্তভোগী। কমেডিয়ানরা তো বটেই।
তবে, বয়কট সংস্কৃতি আসলে আমাদের প্রতিবেশকেই ভাগ ভাগ করে রাখে। তা কোনও ভাবেই কাউকে ইনক্কলুসিভ হয়ে উঠতে দেয় না। যে কমেডির ধরন জনমানসে বিরূপ প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে অনাস্থা জানানো যেতেই পারে। কিন্তু তা যদি একজন কমেডিয়ানকে বাতিলের দিকে এগোয়, তবে সমাজের মন ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। সে প্রশ্নই উঠছে এখন। রোস্টিং পশ্চিমের দেশে যেভাবে সম্ভব, এখানে তা হওয়ার নয়। আবার সবদিক রক্ষা করেও কমেডি হয় না। ফলত এই জায়গায় যেন এক সরু সুতোর উপর দিয়েই হাঁটছেন কমেডিয়ানরা। তাতে বিতর্ক কখনও বাধছে, তার প্রতিকারও মতামত জানিয়েই সম্ভব। তবে রোস্ট কালচারের প্রতিবাদে ক্যানসেল কালচার অনুঘটক হয়ে উঠতে পারে কি? এ প্রশ্নও কিন্তু জরুরি হয়েই থাকল।