যখন কোনও পরিচালক মিসোজিনিকে গৌরবান্বিত করেন, যখন রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের কথায় মিসোজিনি ছড়ায় তখনও একই রকম ক্ষোভের প্রকাশের দেখা মিলবে তো? যদি না মেলে তাহলে বুঝতে হবে, রণবীর একজন ব্যক্তি হিসাবেই যাবতীয় ক্ষোভ মাথায় নিয়ে থেকে গেলেন বা যাবেন। কমেডির নামে গাঢ় অন্ধকারের ছড়িয়ে যাওয়া আটকানো সম্ভব হবে না।
নেটদুনিয়া যেন অশ্লীল-আগার। দেখেও না-দেখা ছিল সভ্য সমাজের মুখোশ। রণবীর এলাহবাদিয়ার ঘটনা যেন সেই মুখোশ এক টানে ছিঁড়ে ফেলেছে। নেটদুনিয়ার তথাকথিত প্রগতিশীলতার তলে তলে বয়ে যাওয়া নোংরা নর্দমার ঢাকনা প্রায় খুলে গিয়েছে বলা যায়।
রণবীর যে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন তাতে সমালোচনা এবং নিন্দার ঝড় গোটা দেশ জুড়ে। তবে কমেডির ছদ্মবেশে এই যে অশ্লীলতা তা তো ভুঁইফোড় কিছু নয়। নেটদুনিয়ায় যাঁরা ঘোরাফেরা করেন, এবং এই ধরনের তথাকথিত ডার্ক কমেডির সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা জানেন ‘কন্টেন্ট’ হিসাবে যা কিছু উপস্থাপিত হয়, তার ভাষা উপস্থাপনা কোন গোত্রের। শালীনতার যদিও কোনও মাপকাঠি হয় না। আর শিল্পের দায় নেই যে সেই সীমা রক্ষা করে যেতে হবে। তবু যা কিছু অশালীন তাকে শিল্প বলে চালানোও একরকম গা-জোয়ারি। এর সঙ্গে মিশে থাকে নারীবিদ্বেষ, এমনকী সম্প্রদায়-বিদ্বেষও। সবই নাকি কমেডি! এসবের উপস্থাপনা নেটদুনিয়ার বিশেষ বিশেষ মুক্ত প্ল্যাটফর্মে। তার দর্শক কারা? সোজা কথায় তাঁরাই, যাঁদের হাতে আছে প্রগতিশীলতার প্রচ্ছদ। একদিকে তাঁরা বেশ পলিটিক্যাল কারেক্ট। অন্যদিকে যা কিছু তার বাইরে সেগুলোর ভোক্তাও তাঁরা। গত কয়েক বছরে এই ধরনের কমেডি প্রায় ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের তথাকথিত সভ্য সমাজের কাছে তা কি অজানা ছিল! মোটেও না। বরং রোস্ট করা যেন স্মার্টনেসের চিহ্ন হয়ে উঠেছে। তা নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা হয়েছে অল্পই। ফলত এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা যে আছে তা ধরেই নিয়েছেন কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা। দর্শক সংখ্যা বা কন্টেন্টের ভিউ তাঁদের ধারণাকে পোক্ত করেছে। এই ফাঁক গলেই এসেছে একের পর এক শো, যা আদতে কমেডির নামে কমেডির মাত্রা ও সূক্ষ্ম প্রকাশকেই প্রায় ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। এই প্রেক্ষিত তৈরিই ছিল। সেখান থেকেই রণবীরের এই মন্তব্য। যে-মন্তব্য ভারতীয় মন ও মননের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছে। ফলত, যেন পচা ডিম বা টমেটো ছোড়ার মতো করেই তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে সমাজের একাংশ। এবং রণবীর পড়েছেন আইনি গেরোয়।
রণবীরের মন্তব্য বা অবস্থানকে সমর্থন করার কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু এই অবকাশে দেখে নেওয়া যেতে পারে যে, রসিকতার মাত্রা নেমে যাওয়ার ক্ষেত্রে দর্শকের ভূমিকা ঠিক কতখানি। কমেডির সূত্রে আইনি গেরোয় এর আগে অনেকেই পড়েছেন। মুনওয়ার ফারুকি বা কুণাল কামরার ঘটনা ভুলে যাওয়ার নয়। তবে, রণবীরের ক্ষেত্রে ঘটনার মাত্রা একেবারেই অন্যরকম। তথাকথিত যা কিছু ‘ডার্ক’ এবং ‘ডার্টি’ তা দীর্ঘদিন ধরেই ‘কনজিউম’ করছেন দর্শক। তাহলে একা রণবীর কেন উঠলেন কাঠগড়ায়? খেয়াল করার মতো বিষয় যে, রণবীর নিজে কমেডিয়ান নন। বা, তাঁর স্ট্যান্ড আপ কমেডি নেই, তিনি এই ধরনের কন্টেন্ট তৈরি করেন। পডকাস্টার হিসাবে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন খুব অল্প সময়ের মধ্যে। এবং তাঁর পডকাস্টের মধ্যে ডার্ক কমেডির ছিটেফোঁটাও ছিল না। ছিল আত্মোন্নতির কথা, বড় মানুষদ্র জীবনের গল্প থেকে প্রেরণা নেওয়ার কথা ইত্যাদি। ছিল আধুনিক সময়ের জীবনদর্শনের নানা কথা। যা ব্যাপক অর্থে প্রভাবিত করে তরুণ প্রজন্মকে। এক অর্থে তরুণদের ভাবনাচিন্তা নিয়ন্ত্রণে রণবীরের পডকাস্টের ভূমিকা ছিল। তাই তাঁর ফ্যান ফলোয়িং ছিল দেখার মতো। যা এই ঘটনার প্রতি কমছে। অর্থাৎ যে আদর্শ পডকাস্টার জীবনকে অন্যরকম ভাবে তুলে ধরত, তাঁর মুখ থেকে কেন অশালীন কথা বেরোল? সম্ভবত যাবতীয় ক্ষোভের মূল জায়গা এটিই। নইলে কমেডির নামে ডার্টি পিকচার তো গা সওয়াই হয়ে গিয়েছিল। আর জনপ্রিয়তার নিরিখে রণবীর তো রীতিমতো প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদমাধ্যমকে টেক্কা দিচ্ছিল বলা যায়। সুতরাং যে-মুখে আদর্শের বাণী সেখানে এই ধরনের মন্তব্য বেমানান? নাকি যে কোনও কেউ এই ধরনের কথা বললে তাই-ই হয়ে উঠত প্রতিবাদের বিষয়? এই হল প্রশ্ন। যদি প্রথম প্রশ্নটিই একমাত্র কারণ হয় তাহলে, দ্বিতীয় প্রশ্নটি বেশি গুরুত্ব পায়। অর্থাৎ ধরে নিতে হয় যে, রণবীর ছাড়া অন্য কেউ এরকম কথা বললে তা নিয়ে এত হইচই হত না। অর্থাৎ সেই দেখেও না-দেখা, যা প্রকারন্তরে অনুমোদন হিসাবেই গণ্য হচ্ছে। যে অনুমোদনের সূত্রে বেড়ে উঠছে এই রোস্ট-ইন্ডাস্ট্রি।
অতএব প্রশ্ন ঘুরেফিরেই সেই এক জায়গাতেই। স্মার্ট, আধুনিক, শ্লীল-অশ্লীলের বিতর্কের ফাঁক গলে আমাদের এই সমাজই কি প্রশ্রয় দিচ্ছে না এই ধরনের ইন্ডাস্ট্রিকে? যাতে এই ধরনের কন্টেন্ট তৈরি করার ইচ্ছে প্রকাশ করছেন বহু তরুণ কন্টেন্ট ক্রিয়েটর? বর্তমানে যে ক্ষোভ প্রকাশ হচ্ছে তা সঙ্গত হলেও, বলা যেতে পারে, এই ক্ষোভ এতদিন চাপা ছিল কেন? আর এই ক্ষোভ সকলের ক্ষেত্রে কি প্রযোজ্য হবে? যখন কোনও পরিচালক মিসোজিনিকে গৌরবান্বিত করেন, যখন রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের কথায় মিসোজিনি ছড়ায় তখনও একই রকম ক্ষোভের প্রকাশের দেখা মিলবে তো? যদি না মেলে তাহলে বুঝতে হবে, রণবীর একজন ব্যক্তি হিসাবেই যাবতীয় ক্ষোভ মাথায় নিয়ে থেকে গেলেন বা যাবেন। কমেডির নামে গাঢ় অন্ধকারের ছড়িয়ে যাওয়া আটকানো সম্ভব হবে না। ভারতীয়রা তা মেনে নেবেন কি-না, সে ভার তাঁদেরই উপর। কন্টেন্ট ক্রিয়েটারদের কাছে যাঁদের পরিচয় আসলে ‘ভিউ’। রণবীরের ঘটনা এই প্রশ্নই তুলে দিল, দেশের ‘ভিউ’ বদলাবে তো?