এমনিতে তিনি শান্ত বলেই খ্যাত। কিন্তু সেই রাহুল দ্রাবিড়ই কিনা অগ্নিশর্মা। তাও আবার বেঙ্গালুরুর ভরা রাস্তায়। তাঁর সাধের গাড়িতে একটি পণ্যবাহী অটো ধাক্কা দিতেই বেরিয়ে এল দ্য ওয়ালের রণমূর্তি।
লিখলেন সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়।
‘সবুরে মেওয়া ফলে’। মেওয়া কীভাবে ফলে, তা না দেখলেও এই চেনা প্রবাদে অগাধ বিশ্বাস আমাদের চিরকাল। পথে-ঘাটে-জলে-জঙ্গলে আমআদমির লক্ষণ মিলিয়ে আমরা একটা ব্যাপারে সহমত পোষণ করি। ধৈর্য। সেটা নড়েচড়ে গেলে ‘পপাৎ চ, মমাৎ চ’। এই পাটিগণিতের হাতেখড়ি আমাদের হয়েছিল যেসময়, সেই সময়ে ভারতীয় ক্রিকেটে ‘ফ্যাব ফোর’-এর রাজত্ব চলত। সেই ‘চারমূর্তি’ নানা নামে নানা রূপে ভারতীয় ক্রিকেটে বন্দিত হয়েছেন, বিরাজ করেছেন।
এই ধরুন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। অফসাইডে তাঁর ওই দাদাগিরি যারা দেখেছেন, তারা আজও বলবেন সেই চেনা লব্জ– ‘গড অফ অফসাইড’। ভিভিএস চিরকাল স্পেশাল, বিশেষ অস্ট্রেলিয়া নামক ব্যাটিং পরাশক্তির বিরুদ্ধে। আর শচীন? তাঁকে নিয়ে বাড়তি শব্দ খরচ করা বাতুলতা। ক্রিকেট ছাড়ার এক যুগ পরেও তিনি, লিটল মাস্টার, ভারতীয় ক্রিকেট তো বটেই বিশ্বক্রিকেটে ‘ঈশ্বর’ রূপে পূজিত। মজার বিষয়, এর পাশে আরও এক জন ছিলেন। ভক্তরা বলতেন, যখন ঈশ্বরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তখন মাথা ঠেকানোর জন্য পড়ে থাকে যে অনমনীয় প্রাচীর, আমরা তাঁকেই ‘দ্য ওয়াল’ নামে চিনি, তিনি রাহুল শরদ দ্রাবিড়। ধৈর্য শব্দটা তাঁরই পরিপূরক।
২২ গজের যুদ্ধে যখন ত্রাস হয়ে উঠেছেন বোলাররা, তখন হিমশীতল মানসিকতায় সেই গোলাগুলিকে শান্ত করতেন ‘মিস্টার ডিপেন্ডবল’, অবলীলায়। সেই দুর্দমনীয় নির্লিপ্তির গভীরে আমরা খুঁজে পেতাম খাঁটি মুক্তোর মতো একটা শব্দকে– ধৈর্য। ধৈর্যের পরীক্ষায় তিনি যে ক্রিকেটকুলে শ্রেষ্ঠ, সেবিষয়ে তাঁর অতিবড় শত্রুও দ্বিমত পোষণ করবেন না। সে যতই তিনি বিজ্ঞাপনে ‘ইন্দিরানগরের গুণ্ডা’ হন না কেন! অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, বিশ্বকাপজয়ী সেই ভারতীয় কোচের ধৈর্য নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেল সর্বসমক্ষে। প্রশ্ন তুলে দিলেন এক ‘আমআদমি’ অটোওয়ালা!
বেঙ্গালুরুতে দ্রাবিড়ের গাড়িতে ধাক্কা মারে একটি অটো। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারতীয় কিংবদন্তির গাড়ি। তা দেখে ধৈর্য ধরে রাখতে পারেননি ‘মিস্টার ডিপেন্ডবল’। প্রিয় বাহনের এমন দশায় বেশ রাগত দেখিয়েছে দ্রাবিড়ের অভিব্যক্তি। সেই ভিডিও ইতিমধ্যে সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল। কিন্তু তা অন্য কারণে। দেশের আইকনের গাড়িতে ধাক্কা মেরে বিশেষ তাপ-উত্তাপ, অনুতাপ নেই সেই অটোচালকের। উল্টে শোয়েব, ব্রেট লি-দের ঢঙে পাল্টা ‘বাউন্সার’ হেঁকেছেন এই বলে যে, দ্রাবিড় যদি ধৈর্য ধরে ঠিকভাবে গাড়ি চালাতেন, তাহলে এই দুর্ঘটনা ঘটতই না! অর্থাৎ, যত দোষ রাহুল শরদ দ্রাবিড়ের।
মাঠে যে মেজাজে চিরকাল বোলারদের দাদাগিরি ঠান্ডা করেছেন, অটোচালকের ‘রাউডি’ মেজাজকেও সেভাবেই সামলেছেন দ্রাবিড়। আসলে ধৈর্যের সঙ্গে শিষ্টতা, ভদ্রতা যে দ্রাবিড়ীয় সভ্যতার গুণ। সেটা তাঁর চেয়ে ভালো আর কে জানেন। আমরা, এই সোশাল-যুগে দর্শক-সমাজ যেটুকু জানি, তা হল, ‘দশচক্রে ভগবান ভূত হন’, ‘অধৈর্য’-এর দ্রাবিড় তো কোন ছাড়!