লৌকিক ব্রত হোক বা শস্যের আরাধনা; কিংবা খাবার সংরক্ষণ ও পারিবারিকতা বজায় রাখার বার্তা; প্রথার ভিতর বহু রঙের আকাশ লুকিয়ে আছে বলেই আজও তা সমান আদরে পালনীয়।
গোটা সেদ্ধ। বাঙালি সরস্বতী পুজো উদযাপনের সঙ্গেই মিলেমিশে আছে এই প্রথা। আর সেই প্রথার ভিতর যেন নানা পরতের বার্তা।
বাঙালির পার্বণে সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় যোগ। এককালে প্রকৃতিই ছিল মানুষের উপাস্য। পরবর্তী সময়ে নানা বিবর্তনে পার্বণের চেহারা বদলেছে। তবে লৌকিক ইতিহাসের সূত্রগুলো আত্তীকরণ করেই হয়েছে সেই পরিবর্তন। আর তাই খেয়াল করলে দেখা যাবে, সমস্ত পুজো-আচ্চাতেই প্রকৃতির উপাদানের উপাসনা। যেমন, যে কোনও পুজোর শুরুতেই জল স্পর্শ করা হয়। জল জীবনেরই অপর নাম। এই যে জীবন অর্থাৎ প্রাণ, তারই তো উপাসনা। সুতরাং জল বাদ দিয়ে কোনও পুজোই শুরু হয় না। বেদে, জলকে তুলনা করা হয়েছে উতলা মায়ের সঙ্গে। মা যেরকম সন্তানকে লালন করেন, তেমনই জল আমাদের উত্তরণ ঘটায়। পূর্ণ থেকে পূর্ণে মিশে যাওয়ার নিহিত অর্থ সেই জলস্পর্শের মধ্যে। এরকমই প্রকৃতিকে, পুজোর আঙ্গিকে আমরা উপাসনা করি। স্বীকার করি প্রকৃতির কাছে আমাদের ঋণ। সরস্বতী পুজোও এর ব্যতিক্রম নয়। এই যে গোটা সেদ্ধ খাওয়ার প্রথা, তার মধ্যেও যেন প্রকৃতি-মানুষের সখ্যের আখ্যান।
গোটা সেদ্ধ নামের মধ্যেই এই প্রথার অর্থ অনেকটা পরিষ্কার। সবকিছু গোটা অর্থাৎ আস্ত হিসেবেই সেদ্ধ করা হয় বলে এমন নাম। গোটা সেদ্ধ তৈরির জন্য দরকার হয় জোড়া শস্য। ৬টি করে নতুন আলু, রাঙা আলু, বেগুন, শিষ পালং, শিম, মটরশুঁটি। বুঝতে অসুবিধা হয় না, শীতের নতুন শস্যগুলিই রয়েছে এই তালিকায়। যেন নবান্নের মতোই, নতুন শস্য দেবতাকে উৎসর্গ করার রেওয়াজ। এই শাকসবজিগুলি ছাড়াও দরকার হয় সবুজ মুগ, সরষের তেল, আর যেটুকু মশলা রান্নায় পড়ে তাও গোটাই থাকে, অর্থাৎ বাটা হয় না। গোটা সেদ্ধ তৈরির সময় কোনও সবজি কাটা যায় না। এমনকি ছাড়ানো হয় না আলুর খোসাও। এই সূত্রেই খেয়াল করা যায় সরস্বতী পুজোর বিবর্তনকেও। সরস্বতী নদীই নাকি ছিল বৈদিক সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। নদীর দুধারে গড়ে উঠেছিল যে সভ্যতা, তারা শস্য উৎপাদনের জন্য নির্ভর করত এই নদীর উপরেই। অন্নদাত্রী বলে পুজোও করত সরস্বতী নদীকে।প্রাচীন যুগেও নাকি ফসল ভাল হওয়ার কামনায় ব্রত করতেন সরস্বতী নদীতীরের সেই কৃষকরমণীরা। তাকে বলা হত ‘সারস্বত ব্রত’। আর এখনও সরস্বতী পুজোর পরের দিন পালিত হয় শীতল ষষ্ঠী। একান্তই মেয়েদের ঘরোয়া ব্রত। লৌকিকও। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’, বাঙালি ঘরের সেই চিরন্তন মঙ্গলকামনাই লগ্ন হয়ে আছে এই লোকাচারের সঙ্গে। এই আচারের সঙ্গে কোনও মন্ত্র-তন্ত্রের আড়ম্বর জড়িয়ে নেই, বরং এর গায়ে যেন লেগে আছে সেই প্রাচীন মাটির গন্ধ। শস্যই এই ব্রতের মূল উপকরণ। এই দিন রান্না করার নিয়ম নেই। নিয়ম নেই শিল পাতারও, অর্থাৎ মশলা পেষাও বন্ধ পরোক্ষভাবে। আসলে বাড়ির শিল ও নোড়াকে এদিন পুজো করা হয়। আর ব্রতের পালন হয় গোটা সেদ্ধ খেয়ে।
বর্তমান সময়ে এই প্রথার যেন আরও অনেক মাত্রা লক্ষ করা যায়। এই যে নতুন করে রান্না না করে আগেরদিনের গোটা সেদ্ধ খাওয়া, এর মধ্যে যেন আছে খাবার নষ্ট না করার বার্তাও। এই পৃথিবীতে যে পরিমাণ খাবার নষ্ট হয়, তা দিয়ে বহু অভুক্তের পেট ভরতে পারে। সে কথা আমরা আর খেয়াল করি কই? প্রথা যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে, যা ইতিমধ্যে রান্না করা আছে, তা নষ্ট করতে নেই। আত্মনিয়ন্ত্রণের কথাটিও এর মধ্যে সুচারু ভাবে বলা। আবার ঠান্ডা খাওয়ার মধ্যে অনেকে আধ্যাত্মিক সূত্রও দেখেন। বহু প্রথার মধ্যেই এই ঠান্ডা খাওয়ার রেওয়াজটি আছে। উপরন্তু, একসঙ্গে গোটা সেদ্ধ খাওয়ার মধ্যে যে পারিবারিক বন্ধন বা গোষ্ঠী ভাবনায় এক হয়ে থাকার কথাটি আছে, তাও নজর এড়ায় না।
লৌকিক ব্রত হোক বা শস্যের আরাধনা; কিংবা খাবার সংরক্ষণ ও পারিবারিকতা বজায় রাখার বার্তা; প্রথার ভিতর বহু রঙের আকাশ লুকিয়ে আছে বলেই আজও তা সমান আদরে পালনীয়।