যেখানে আধ্যাত্মিকতায় মন সমর্পিত, সেখানে একজনের পোশাক অন্যকে কেন পীড়া দেবে? এ প্রশ্ন তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবু সমষ্টির মন রাখতে যখন পোশাকে, বিশেষত মহিলাদের পোশাকে কোপ পড়ে তখন বুঝতে হয়, সামাজিক ভাবেই এই গোঁড়ামি আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে। এক থাক, এক খোপের যে গোঁড়া কাঠামো তা আবার নতুন করে গিলে ফেলতে চাইছে প্রগতিশীলতার যাবতীয় অর্জন। আর তা হচ্ছে মন্দিরে আসা ভক্তদের অনুমোদনেই।
নতুন পোশাকবিধি এনেছে মুম্বইয়ের বিখ্যাত সিদ্ধিবিনায়ক মন্দির। কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে যে, বিশেষ কয়েকটি পোশাক পরে মন্দিরে আর প্রবেশ করা যাবে না। এর মধ্যে আছে, শর্ট স্কার্ট, এমন পোশাক যাতে শরীরের অনেকটা অংশ দৃশ্যমান, টর্ন ফেব্রিকের ট্রাউজার ইত্যাদি। তবে যে কারণে এই বিধি লাগু হল তা খেয়াল করে দেখার মতো। মন্দির কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, সারা দেশ থেকে বহু ভক্ত আসেন মন্দিরে। কিন্তু কারও কারও পোশাক দেখে অন্য ভক্তরা অস্বস্তি বোধ করেন। এই অভিযোগ তাঁরা পেয়েছেন। সেই নিরিখেই এই সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ নতুন যে পোশাকবিধি আরোপিত হল তার অনেকটা দায়িত্ব মন্দিরে আসা সাধারণ মানুষেরই।
মন্দির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন যে, কারও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দে হস্তক্ষেপ তাঁদের কাম্য নয়। কিন্তু যেহেতু মন্দির এমন একটি পরিসর, যেখানে বহু মানুষের পছন্দ-অপছন্দ মিলেমিশে আছে, সেহেতু একটি সাধারণ নিয়মের দিকেই হাঁটতে হয়েছে। অর্থাৎ অন্য কারও পোশাকের পছন্দ নিয়ে আপত্তি আছে আরও অনেক মানুষেরই। সমষ্টির হাতেই এখানে খর্ব হচ্ছে ব্যক্তির স্বাধীনতা। সিদ্ধিবিনায়কের পোশাকবিধির প্রেক্ষিতে এই দিকটি খেয়াল করোর মতোই। ধর্মস্থানের চরিত্র অনুযায়ীই কিছু কিছু নিয়ম দীর্ঘালালিত। তবে, তার পরিবর্তনেরও ডাক উঠেছে। মনে করা যেতে পারে, কেরলের শিবগিরি মঠের প্রধানের বক্তব্য। সেখানে নিয়ম যে, পুরুষদের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত করে তবেই মন্দিরে ঢুকতে হবে। এককালে যাতে পইতা দেখা যায়, তাই এই নিয়ম শুরু হয়েছিল। জাতিপ্রথাই এই নিয়মের নেপথ্যে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবে আজকের দিনে যে তা আর জরুরি নয় বলেই মনে করেছিলেন মঠ প্রধান। তাই পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন তিনি। প্রায় কাছাকাছি সময়ে সিদ্ধিবিনায়ক কর্তৃপক্ষ উলটো দিকে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে, তাও সমষ্টি তথা জনতার ভাবাবেগের কথা মাথায় রেখে।
:আরও শুনুন:
পরিবর্তন চাই! আদুড় গায়ে পুরুষদের মন্দিরে প্রবেশের প্রথা রদ হোক, উদ্যোগ কেরলে
শালীনতার প্রসঙ্গটিও গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়, মন্দিরে অশালীন পোশাক পরা উচিত নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কোনটি অশালীন তার মাপকাঠি কী? কেই-বা তা ঠিক করে দেয়? অমুক পোশাকটি মন্দিরের জন্য যথোপযুক্ত নয়, এই যে একটি সমষ্টিগত ধারণা তার নেপথ্যে তো থেকে যায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দীর্ঘ ধারণা। সেই জঙ্গমতাই আসলে ভাবতে শেখায় যে, কোন পোশাক পরে কোথায় যাওয়া আর কোথায় উচিত নয়। আদতে তাইই নীতিপুলিশির গোড়ার কথা, যা কোনও রকম ‘অপর’ বরদাস্ত করে না। বরং যা কিছু একমাত্রিক নয়, তাকেই বয়কট করে। আর এই বয়কটের গোড়াপত্তন হয় সমষ্টির হাত ধরেই। তা শাসন করতে চায় ব্যক্তিকে। ব্যক্তির ইচ্ছে, স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রতার অনুশীলনকে। ঠিক যেভাবে দল ডানা ছেঁটে এক থাকে ঢুকিয়ে দিতে চায় মানুষকে। সামাজিক স্তরে যখন তা তুলে আনা হয় তখনই তা আসে এই বিধির নাম দিয়ে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এখানে যে যে পোশাকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে অধিকাংশই মহিলাদের পরনের পোশাক। এবার যদি জনতার অভিযোগের প্রসঙ্গটি পাশে রাখা যায় তাহলে এই বিধির নিহিতার্থ অধরা থাকে না। প্রকারন্তরে মহিলাদের পোশাকবিধিই এখানে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, আর হচ্ছে সমষ্টির হাতে, সামাজিকতার দোহাই দিয়ে। এই যে ধারাবাহিক প্রক্রিয়া তা শুধু ব্যক্তিস্বার্থের পরিপন্থী নয়, স্বাধিকার অর্জনে মহিলাদের যে এগিয়ে চলা, তাতেও বাধাই দিচ্ছে।
অথচ এই ধর্মীয় স্থানই পুরুষতন্ত্রের চেনা বয়ান খানিক বদলে দিতে পারত। যেমন হয়েছে কুম্ভের ক্ষেত্রে। কোটি মানুষের ভিড়। সেখানে প্রকাশ্যেই স্নান করছেন সাধ্বীরা, অন্যান্য মহিলা ভক্তরা। তাঁদের অনেকেই মনেকরছিলেন যে, মেল গেজের চেনা অস্বস্তি তাঁদের কাছে এখানে তেমন কাঁটা হয়ে দেখা দেয়নি। সে কথা সংবাদমাধ্যমকে জানাতেও কসুর করেননি তাঁরা। ব্যতিক্রম হলেও এ কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। সাধারণ পরিবেশ যে মেল গেজকে মুছে দিতে পারে না, সাংস্কৃতিক অনুশীলনে তা যেন অনেকটাই মিলিয়ে গিয়েছিল। যে কোনও ধর্মস্থানই সেই অনুশীলনের জায়গা। যেখানে আধ্যাত্মিকতায় মন সমর্পিত, সেখানে একজনের পোশাক অন্যকে কেন পীড়া দেবে? এ প্রশ্ন তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবু সমষ্টির মন রাখতে যখন পোশাকে, বিশেষত মহিলাদের পোশাকে কোপ পড়ে তখন বুঝতে হয়, সামাজিক ভাবেই এই গোঁড়ামি আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে। এক থাক, এক খোপের যে গোঁড়া কাঠামো তা আবার নতুন করে গিলে ফেলতে চাইছে প্রগতিশীলতার যাবতীয় অর্জন। আর তা হচ্ছে মন্দিরে আসা ভক্তদের অনুমোদনেই।
যে জায়গা থেকে মুক্তির নতুন ভাষ্য মিলত, মেলার কথা ছিল, তাই-ই যেন হয়ে উঠছে পালটপুরাণ। এই পোশাকবিধি কি তাহলে আমাদের সামাজিক অনগ্রসরতারই নমুনা? এ প্রশ্ন তাই যেন না করলেই নয়!